বিশ্বের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারত তথা বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। তিনি প্রথম এশিয়াকে সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ গৌরবের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি ছিলেন বাংলা তথা ভারতের বিশিষ্ট কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটোগল্পকার, সংগীতস্রষ্টা, নট ও নাট্যকার, চিত্রকর, প্রাবন্ধিক, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। তিনি বাংলা ভাষার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক। রবীন্দ্রনাথকে ‘গুরুদেব’, ‘বিশ্বকবি’ ও ‘কবিগুরু’ অভিধায় অভিহিত করা হয়। ভারতের জন্য তিনি এনে দিয়েছিলেন অপরিমেয় সম্মান ও গৌরব। তিনি শুধু বাংলার নয়, তিনি বিশ্বের কবি রবি ঠাকুর।
জন্ম ও বংশ পরিচয়
১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ৭ই মে,বাংলা ১২৬৮ সালের ২৫শে বৈশাখ কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে রবীন্দ্রনাথের জন্ম। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান তিনি। মাতা সারদা দেবী।বাল্যে প্রথাগত শিক্ষা গ্রহণে তিনি অসম্মত হয়েছিলেন। তাই গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করে বাড়িতেই তাঁর শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। মাত্র দশ-এগারো বছর বয়সে কাব্যরচনায় প্রবৃত্ত হন তিনি। ১৮৭৪ সালে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। কবিতাটির নাম ছিল ‘অভিলাষ’। এটিই ছিল তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা। ১৮৭৮ সালে সতেরো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ প্রথম ইংল্যান্ড ভ্রমণ করেন। ১৮৮৩ সালে মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। ১৮৯০ সাল থেকে তিনি পূর্ববঙ্গের শিলাইদহের জমিদারি এস্টেটে বসবাস শুরু করেন। ১৯০১ সালে চলে আসেন পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে। এখানেই ব্রহ্মচর্যাশ্রম স্থাপন করে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন।
সাহিত্যসৃষ্টি
রবীন্দ্রনাথ বাল্যকাল থেকেই কবিতা রচনা শুরু করেছিলেন।তাঁর কবিতার মধ্যে কত যে উপলব্ধির প্রাণ প্রতিষ্ঠা ঘটেছে,তা বলে শেষ করা যাবে না।ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে রবীন্দ্রনাথের ন’টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এগুলি হল: ‘মানসী’ (১৮৯০), ‘সোনার তরী’ (১৮৯৪), ‘চিত্রা’, ‘চৈতালি’ (১৮৯৬), ‘কণিকা’ (১৮৯৯), ‘কথা’, ‘কাহিনী’, ‘কল্পনা’ ও ‘ক্ষণিকা’ (১৯০০)। ১৮৯০ সালে পূর্ববঙ্গের সাজাদপুরে বসে তিনি লেখেন ‘বিসর্জন’ নাটকটি। ১৮৯২ সালে প্রকাশিত হয় নাট্যকাব্য ‘চিত্রাঙ্গদা’। সেই সঙ্গে নিয়মিত গীতিচর্চাও করতে থাকেন রবীন্দ্রনাথ। ১৮৯৪ সালে গ্রহণ করেন ‘সাধনা’ পত্রিকার সম্পাদনার ভার। এই পত্রিকাতেই সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ কিছু গদ্যরচনা প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য, ‘গল্পগুচ্ছ’ গল্পসংকলনের প্রথম ৮৪টি গল্পের অর্ধেকই এই সময়ের রচনা। এই গল্পগুলির রসদ তিনি সংগ্রহ করেছিলেন পূর্ববঙ্গের গ্রামীণ হিন্দুসমাজ থেকে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস বাংলা ভাষায় তাঁর অন্যতম জনপ্রিয় সাহিত্যকর্ম। ১৮৮৩ থেকে ১৯৩৪ সালের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ১৩টি উপন্যাস রচনা করেছিলেন। এগুলি হল: ‘বৌ-ঠাকুরাণীর হাট’ (১৮৮৩), ‘রাজর্ষি’ (১৮৮৭), ‘চোখের বালি’ (১৯০৩), ‘নৌকাডুবি’ (১৯০৬), ‘প্রজাপতির নির্বন্ধ’ (১৯০৮), ‘গোরা’ (১৯১০), ‘ঘরে বাইরে’ (১৯১৬), ‘চতুরঙ্গ’ (১৯১৬), ‘যোগাযোগ’ (১৯২৯), ‘শেষের কবিতা’ (১৯২৯), ‘দুই বোন’ (১৯৩৩), ‘মালঞ্চ’ (১৯৩৪) ও ‘চার অধ্যায়’ (১৯৩৪)।
গল্পগুচ্ছ সংকলনের অন্য গল্পগুলির অনেকগুলিই রচিত হয়েছিল রবীন্দ্রজীবনের ‘সবুজ পত্র’ পর্বে (১৯১৪–১৭; প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত পত্রিকার নামানুসারে)। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গল্প হল ‘কঙ্কাল’, ‘নিশীথে’, ‘মণিহারা’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘স্ত্রীর পত্র’, ‘নষ্টনীড়’, ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘হৈমন্তী’, ‘দেনাপাওনা’, ‘মুসলমানীর গল্প’ ইত্যাদি। শেষ জীবনে রবীন্দ্রনাথ ‘লিপিকা’, ‘সে’ ও ‘তিনসঙ্গী’ গল্পগ্রন্থে নতুন আঙ্গিকে গল্পরচনা করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় অসংখ্য প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। এইসব প্রবন্ধে তিনি সমাজ, রাষ্ট্রনীতি, ধর্ম, সাহিত্যতত্ত্ব, ইতিহাস, ভাষাতত্ত্ব, ছন্দ, সংগীত ইত্যাদি নানা বিষয়ে নিজস্ব মতামত প্রকাশ করেন। রবীন্দ্রনাথের সমাজচিন্তামূলক প্রবন্ধগুলি ‘সমাজ’ (১৯০৮) সংকলনে সংকলিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন সময়ে লেখা রাজনীতি-সংক্রান্ত প্রবন্ধগুলি সংকলিত হয়েছে ‘কালান্তর’ (১৯৩৭) সংকলনে। রবীন্দ্রনাথের ধর্মভাবনা ও আধ্যাত্মিক অভিভাষণগুলি সংকলিত হয়েছে ‘ধর্ম’ (১৯০৯) ও ‘শান্তিনিকেতন’ (১৯০৯-১৬) অভিভাষণমালায়। রবীন্দ্রনাথের ইতিহাস-সংক্রান্ত প্রবন্ধগুলি স্থান পেয়েছে ‘ভারতবর্ষ’ (১৯০৬), ‘ইতিহাস’ (১৯৫৫) ইত্যাদি গ্রন্থে। ‘সাহিত্য’ (১৯০৭), ‘সাহিত্যের পথে’ (১৯৩৬) ও ‘সাহিত্যের স্বরূপ’ (১৯৪৩) গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যতত্ত্ব আলোচনা করেছেন।
সম্মান
১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে সাহিত্য-সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ লাভ করলেন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার নোবেল প্রাইজ। সমগ্র এশিয়ার জন্য তিনি নিয়ে এলেন বিরাট এক গৌরবের বিজয়মালা।
সংগীত
রবীন্দ্রনাথ সংগীত সৃষ্টিতেও অসামান্য দক্ষতা দেখিয়েছেন।হাজার হাজার সংগীতের সুরকারও তিনি স্বয়ং।এই সকল সংগীত বিশ্বের সকলল মানবের জীবনের মর্মবাণী। তাঁর গানগুলি ‘রবীন্দ্রসংগীত’ নামে পরিচিত। ধ্রুপদি ভারতীয় সংগীত (হিন্দুস্তানি ও কর্ণাটকী শাস্ত্রীয় সংগীত), বাংলা লোকসংগীত ও ইউরোপীয় সংগীতের ধারা তিনটিকে আত্মস্থ করে তিনি একটি স্বকীয় সুরশৈলীর জন্ম দেন।রবি ঠাকুর তাঁর বহু কবিতাকে গানে রূপান্তরিত করেছিলেন। রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ সুকুমার সেন রবীন্দ্রসংগীত রচনার ইতিহাসে চারটি পর্ব নির্দেশ করেছেন।প্রথম পর্বে তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্ট গীতের অনুসরণে গান রচনা শুরু করেছিলেন।
দ্বিতীয় পর্যায়ে (১৮৮৪-১৯০০) পল্লীগীতি ও কীর্তনের অনুসরণে রবীন্দ্রনাথ নিজস্ব সুরে গান রচনা শুরু করেন। এই পর্বের রবীন্দ্রসংগীতে ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট সংগীতস্রষ্টা মধুকান, রামনিধি গুপ্ত, শ্রীধর কথক প্রমুখের প্রভাবও সুস্পষ্ট। এই সময় থেকেই তিনি স্বরচিত কবিতায় সুর দিয়ে গান রচনাও শুরু করেছিলেন। ১৯০০ সালে শান্তিনিকেতনে বসবাস শুরু করার পর থেকে রবীন্দ্রসংগীত রচনার তৃতীয় পর্বের সূচনা ঘটে। এই সময় রবীন্দ্রনাথ বাউল গানের সুর ও ভাব তাঁর নিজের গানের অঙ্গীভূত করেন।
স্বদেশপ্রেম
রবীন্দ্রনাথ স্বদেশপ্রেমিক কবি।তাঁর অনুপ্রেরণায় তৈরি হয়েছে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অনেক কর্মসূচী। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ‘ আমার সোনার বাংলা ’ ও ভারতের জাতীয় সঙ্গীত ‘ জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে ’কবিগুরুর রচনা। তিনিই একমাত্র ব্যক্তিত্ব যিনি দুটি রাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীতের স্রষ্টা। জালিয়ানওয়ালাবাগের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ব্রিটিশ সরকার প্রদত্ত ‘নাইট’ উপাধি পরিত্যাগ করেন।
বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা
নতুন পদ্ধতিতে শিক্ষাদানের জন্য তিনি ‘শান্তিনিকেতন’ আদর্শ শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তোলেন। এখানেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাঠভবন নামে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ১৯২১ সালে এখানে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫১ সালের মধ্যে বিশ্বভারতী ভারতের অন্যতম কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়। এন্ডরুস, অ্যালেক্স অ্যারনসনের মতো বিশ্ববিখ্যাত শিক্ষাবিদরা এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত হন। গায়ত্রী দেবী, ইন্দিরা গান্ধী, সত্যজিৎ রায়, আবদুল গনি খান, সৈয়দ মুজতবা আলী, নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতো বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিত্বরা বিশ্বভারতীর শিক্ষার্থী ছিলেন। বিশ্বভারতীর কলাভবনকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ চারুকলা শিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে গণ্য করা হয়।
প্রয়াণ
বিশ্বমনস্ক কবি মৃত্যুর পূর্বে প্রত্যক্ষ করেছেন মানবসভ্যতার গভীর সঙ্কটকে। তথাপি তিনি মানুষের মহত্ত্বে চির-আস্থাবান ছিলেন। কালান্তর (১৯৩৭) ও সভ্যতার সঙ্কট (১৯৪১)-এ কবির সেই বিশ্বাসের সুর অক্ষুণ্ণ রয়েছে। রবীন্দ্রনাথের অন্তিম বাণী সভ্যতার সঙ্কট। এ ভাষণ তিনি পড়েছিলেন তাঁর শেষ জন্মোৎসব অনুষ্ঠানে। সেবার কবির আশি বছর পূর্ণ হয়। ১৯৪০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কবি কালিম্পঙ গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন থেকে তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। ১৯৪১ সালের ৭ই আগস্ট (বাংলা ২২শে শ্রাবণ ১৩৪৮) জোড়াসাঁকোর বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
মূল্যায়ন
রবীন্দ্রনাথের অজস্র দানে বিশ্বের সাহিত্যভাণ্ডার সমৃদ্ধ।বাঙালির কর্মে,চিন্তায়,সাহিত্যে,শিল্পে,সংস্কৃতিতে, ঐতিহ্যে তিনি নবজীবন-চেতনা সঞ্চার করেছিলেন।নিখিল মানবহৃদয়ে চিরদিনই তিনি অমর।