প্রত্যয় – একটি সরল আলোচনা
প্রত্যয় অনেকের কাছে একটি জটিল বিষয়। কিন্তু কিছু বিষয় মাথায় রাখলে প্রত্যয়ের মতো জটিল বিষয়ও আমাদের কাছে অনেকাংশে সহজ হয়ে যায়। প্রত্যয়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এমন কয়েকটি বিষয় আমাদের এই পোস্টে আলোচনা করা হয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের সুবিধার্থে সকল বিষয়গুলি নীচে আলোচনা করা হল।
সাধারণ ধারণা
বাংলা ব্যাকরণে যে সমস্ত উপায়ে নতুন শব্দ গঠন করা হয় তার মধ্যে প্রকৃতি-প্রত্যয়ের আলোচনাটি অন্যতম। প্রত্যয় হল সেই সমস্ত বর্ণ বা বর্ণগুচ্ছ যা প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে সর্বদা নতুন একটি শব্দ গঠন করে। অর্থাৎ প্রত্যয়ের কাজ হল নতুন নতুন শব্দ গঠন করা।
এখন প্রশ্ন, প্রত্যয় কার সঙ্গে যুক্ত হয়ে একটি নতুন শব্দ গঠন করে ?
এর উত্তর হল, প্রত্যয় প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে একটি নতুন শব্দ গঠন করে।
প্রত্যয় সম্পর্কে তো বোঝা গেল, কিন্তু প্রকৃতি কী ? প্রকৃতি হল কোনো শব্দের আদি রূপ। এই রূপটি হতে পারে কোনো ধাতু অথবা কোনো শব্দ। মনে রাখতে হবে এই প্রকৃতি হল অবিভাজ্য। অর্থাৎ, প্রত্যয় কখনও ধাতুর সঙ্গে অথবা কখনও শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয়ে একটি নতুন শব্দ গঠন করে। উদাহরণ দ্রষ্টব্য –
উদাহরণ – ১
‘দাতা’ শব্দটির বিশ্লেষণে আমরা পাই — দা + তৃচ্। এই বিশ্লেষণে প্রাপ্ত ‘দা’ হল ধাতু (প্রকৃতি) এবং ‘তৃচ্’ হল প্রত্যয়। তৃচ্ প্রত্যয়টি ‘দা’ ধাতুর সঙ্গে যুক্ত হয়ে নতুন শব্দ ‘দাতা’ গঠন করেছে।
উদাহরণ – ২
‘মানব’ শব্দটির বিশ্লেষণে আমরা পাই — মনু + ষ্ণ। এই বিশ্লেষণ দ্বারা প্রাপ্ত ‘মনু’ হল শব্দ (প্রকৃতি) এবং ‘ষ্ণ’ হল একটি প্রত্যয়। অর্থাৎ এখানে ‘ষ্ণ’ প্রত্যয়টি ‘মনু’ শব্দপ্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে নতুন শব্দ ‘মানব’ গঠন করেছে। তাহলে স্পষ্টতই আমরা দেখলাম, প্রত্যয় প্রকৃতির (ধাতু বা শব্দ) সঙ্গে যুক্ত হয়ে সব সময় নতুন একটি শব্দ গঠন করে।
প্রকৃতি-প্রত্যয় নির্ণয় করার পূর্বে কিছু বিষয় জেনে নেওয়া প্রয়োজন। যেমন –
প্রাতিপাদিক
ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে ‘প্রতিপদ’ শব্দের অর্থ ‘আরম্ভ’। অর্থাৎ আমরা বলতে পারি যে সকল শব্দ থেকে বিভক্তিযুক্ত পদের আরম্ভ হয় তাকে প্রাতিপাদিক বলে। প্রাতিপদিক হল বিভক্তিহীন নামশব্দ। নামপদের যে অংশটিকে আর বিশ্লেষণ করা যায় না বা ভাঙা যায় না, তাকেই প্রাতিপদিক বলে। যেমন – ‘মা’। এই নাম শব্দের সঙ্গে কোনো বিভক্তি নেই। এর সঙ্গে ‘কে’ যুক্ত করে নতুন শব্দ ‘মাকে’ পদটি তৈরি করা যেতে পারে।
ক্রিয়ামূল বা ধাতু
ক্রিয়াপদের মূলশব্দকে বলা হয় ক্রিয়ামূল বা ধাতু। যেমন- ‘চল্’। এটি নিজেই একটি ক্রিয়াপদ। আবার এর সঙ্গে বিভক্তি যুক্ত হয়ে কাল ও পুরুষভেদে ক্রিয়াটির রূপ পরিবর্তিত হতে পারে। যেমন- চলো, চলুন, চলছি ইত্যাদি। ধাতু চিহ্নিত করা হয় (√) চিহ্ন দ্বারা। অর্থাৎ √চল্ মানে ‘চল্’ ধাতু।
কৃদন্ত পদ
কৃৎ প্রত্যয়ান্ত পদটিকে বলা হয় কৃদন্ত পদ। যেমন – অগ্র – জন্ + ড। এখানে জন্ + ড = জ হল কৃৎ প্রত্যয়ান্ত পদ।
তদ্ধিতান্ত পদ
তদ্ধিত প্রত্যয় সাধিত শব্দকে তদ্ধিতান্ত পদ বলে। যেমন – লাজ + উক = লাজুক
প্রকৃতি
শব্দের যে অংশ বিশ্লেষণযোগ্য নয় বা সেটি আর ভাঙা যায় না, তাকে প্রকৃতি বলে। প্রত্যয় যুক্ত প্রতিটি মৌলিক শব্দ একটি করে প্রকৃতি। কিন্তু মৌলিক শব্দকে প্রকৃতি বলতে পারি না। যখন সেই শব্দের সঙ্গে প্রত্যয় যুক্ত হয়ে একটি নতুন শব্দ গঠন করে, তখন সৃষ্ট শব্দটির মূল শব্দটিকে প্রকৃতি বলা যায়।
অর্থাৎ, প্রত্যয় দ্বারা নিষ্পন্ন শব্দের মূলটিকে বলা হয় প্রকৃতি। যেমন – খা, গম্ পড়্, নাচ, লাজ ইত্যাদি।
প্রকৃতি দুই প্রকার –
১. নাম প্রকৃতিঃ শব্দের সঙ্গে প্রত্যয় যুক্ত হলে সেটিকে নাম প্রকৃতি বলে। যেমন,ঋণ + ইন্ = ঋণী
২. ক্রিয়া প্রকৃতিঃ ধাতুর সঙ্গে প্রত্যয় যুক্ত হলে ধাতুটিকে ক্রিয়া প্রকৃতি বলে। যেমন, √ফুট্ + অন্ত = ফুটন্ত
প্রত্যয়
প্রত্যয় হল বর্ণ বা বর্ণগুচ্ছ যা কোনো ধাতু বা শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নতুন একটি শব্দ গঠন করে। যেমন – চলন্ত’ শব্দটিকে ভাঙলে আমরা পাই চল্ + অন্ত। এখানে ‘চল্’ ধাতুর সঙ্গে ‘অন্ত’ যুক্ত হয়ে নতুন শব্দ ‘চলন্ত’ তৈরি হয়েছে। এই ‘অন্ত’ হল প্রত্যয়।
যেমন – রাম + ষ্ণায়ন = রামায়ণ, বড় + আই = বড়াই, আ – কৃষ্ + ক্ত = আকৃষ্ট ইত্যাদি।
প্রকৃতি + প্রত্যয় = প্রত্যয়সাধিত শব্দ
ঋণী = ঋণ + ইন্ = ঋণী
ঘর + আমি = ঘরামি
ফুট্ + অন্ত = ফুটন্ত
পড়্ + উয়া = পড়ুয়া
নাচ্ + উনে = নাচুনে
বাঁশ + ই = বাঁশি
প্রত্যয়ের দুটি শ্রেণি –
১. ধাতু প্রত্যয় বা কৃৎ প্রত্যয়ঃ কোনো ধাতুর সঙ্গে যখন একটি প্রত্যয় যুক্ত হয়ে নতুন শব্দ গঠন করে তখন তা ধাতু প্রত্যয় বা কৃৎ প্রত্যয় হয়।
উদাহরণ – ভাস্ + মান = ভাসমান, শম্ + ক্তি = শান্তি, বচ্ + তব্য = বক্তব্য, বস্ + অতি = বসতি ইত্যাদি। এখানে ‘ভাস্’, ‘শম্’, ‘বচ্’ এবং ‘বস্’ হল ধাতু। এই ধাতুগুলির সঙ্গে যথাক্রমে ‘মান’, ‘ক্তি’, ‘তব্য’, এবং ‘অতি’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে নতুন শব্দগুলি তৈরি হয়েছে।
২. শব্দ প্রত্যয় বা তদ্ধিত প্রত্যয়ঃ কোনো শব্দের সঙ্গে যখন একটি প্রত্যয় যুক্ত হয়ে নতুন শব্দটি গঠন করে তখন তা শব্দ প্রত্যয় বা তদ্ধিত প্রত্যয় হয়।
উদাহরণ – শক্তি + ষ্ণ = শাক্ত, নর + ষ্ণায়ন = নারায়ণ, ক্ষুধা + ইত = ক্ষুধিত, পাগল + আমি = পাগলামি ইত্যাদি। এখানে ‘শক্তি’, ‘নর’, ‘ক্ষুধা’, এবং ‘পাগল’ এক একটি শব্দ যার সঙ্গে যথাক্রমে ‘ষ্ণ’, ‘ষ্ণায়ন’, ‘ইত’ এবং ‘আমি’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে নতুন শব্দ তৈরি হয়েছে।