ভূদেব মুখোপাধ্যায়
ভূদেব মুখোপাধ্যায় ছিলেন ঊনবিংশ শতকে বাংলা গদ্য সাহিত্যের একজন স্মরণীয় ব্যক্তি। যাঁর একদিকে ছিল ‘খ্রীস্ট’ ধর্মানুরাগ এবং অন্যদিকে ছিল পরিশোধিত ‘ব্রাহ্ম’ ভাবনার প্রকাশ।
জন্মঃ ভূদেব মুখোপাধ্যায় ১৮২৭ খ্রীস্টাব্দের ২২শে ফেব্রুয়ারী জন্মগ্রহণ করেন হুগলীর নতিবপুর গ্রামে প্রসিদ্ধ পন্ডিত বংশে। পিতার নাম ছিল বিশ্বনাথ তর্কভূষণ ।
শিক্ষাঃ ভূদেব মুখোপাধ্যায় প্রথমে সংস্কৃত কলেজে পড়াশোনা করেন । পরে হিন্দু কলেজে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন এবং সেখানে তৃতীয় পর্বের ছাত্র ছিলেন । এনার সহপাঠী ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত । পন্ডিত বংশের ঐতিহ্য , বিশেষত তাঁর পিতামহ সার্বভৌম মহাশয়ের ও পিতা সনাতন হিন্দুধর্মের প্রতি ঐকান্তিক নিষ্ঠা ভূদেবকে যথেষ্ট প্রেরণা দেয় । মা ব্রাহ্মময়ীর কাছ থেকে পান দেশপ্রেমের মন্ত্রদীক্ষা ।
কর্মজীবনঃ ইনি পূর্ণোদ্যামে তাঁর আচরণে ও রচনায় সদাচারের মহিমা-কীর্তনে ব্রতী হয়েছিলেন । এই সদাচার প্রবর্তনে তাঁর লক্ষ্য ছিল প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্রের গৌরব ও প্রাচীন হিন্দু ধর্মের মহিমাকে উজ্জীবিত করা । ১৮৪৫ খ্রীস্টাব্দে তিনি হিন্দু কলেজ ত্যাগ করেন ও কিছুদিন হিন্দু হিতার্থী বিদ্যালয়ে এবং চন্দপনগর সেমিনারীতে শিক্ষকতাও করেন । ১৮৪৮ এ কলকাতা মাদ্রাসায় ইংরাজী বিভাগে দ্বিতীয় শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন । ১৮৬৪ তে অতিরিক্ত বিদ্যালয় পরিদর্শকের কাজে যোগ দেন । ১৮৮৩ তে হান্টার কমিশনের সদস্য হিসাবে অবসর নেন ।
ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের রচনাবলী
‘শিক্ষা বিধায়ক প্রস্তাব’ (১৮৫৬) ,
‘প্রাকৃতিক বিজ্ঞান’ (১৮৫৮, ১৮৫৯), ‘পুরাবৃত্তকার’ (১৮৬২) ,
‘ইংলন্ডের ইতিহাস’ (১৮৬২) ,
‘ক্ষেত্রতত্ত্ব’ (১৮৬৩) ,
‘রোমের ইতিহাস’ (১৮৬৩) ,
‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ (১৯০৪) ,
‘পারিবারিক প্রবন্ধ’ (১৮৮২) ,
‘সামাজিক প্রবন্ধ’ (১৮৯২) ,
‘আচার প্রবন্ধ’ (১৮৯৪) ,
‘ঐতিহাসিক উপন্যাস’ (১৮৬২) ,
‘পুষ্পাঞ্জলী’ (১৮৬৩) ,
‘স্বপ্নলব্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাস’ (১৮৯৫) ,
‘বিবিধ প্রবন্ধ’ (১৮৯৫, ১৯০৫) ।
পত্রিকা সম্পাদনা
‘এডুকেশন গেজেট’ (১৮৩৬) ,
‘শিক্ষাদর্পন’ ও ‘সংবাদসার’ (১৮৬৪) ।
ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের সাহিত্যকর্ম
১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষার উপরে শিক্ষাদর্পণ নামে দু আনা দামের মাসিক পত্রিকা পরিচালনা করেন । ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে চুঁচুড়া থেকে সরকারী পত্রিকা এডুকেশন গেজেট এবং এবং সাপ্তাহিক বার্তাবহ পত্রিকা সম্পাদনা করেন । তাঁর রচিত স্বপ্নলব্ধ ভারতের ইতিহাস বইতে কাল্পনিক ঘটনার সাহায্যে তিনি ভারতের জাতীয় চরিত্রের দুর্বলতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষন করেন । তাঁর রচিত ঐতিহাসিক উপন্যাস বইতে “সফল স্বপ্ন” এবং “অঙ্গুরীয় বিনিময়” নামে দুটি গল্প ছিল । “অঙ্গুরীয় বিনিময়” গল্পটির কাহিনী কিছুটা ইতিহাস থেকে নেওয়া হলেও গল্পটি মৌলিক রচনার পর্যায়ে পড়ে । বাংলা ঐতিহাসিক উপন্যাসের এখানেই সূত্রপাত হয় । ভূদেব মুখোপাধ্যায় রচিত অন্যান্য বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পারিবারিক প্রবন্ধ , সামাজিক প্রবন্ধ , আচার প্রবন্ধ , বিবিধ প্রবন্ধ , পুষ্পাঞ্জলি , এবং বিদ্যালয় পাঠ্য প্রাকৃতিক বিজ্ঞান , ক্ষেত্রতত্ত্ব , পুরাবৃত্তসার, বাঙলার ইতিহাস , ইংল্যান্ডের ইতিহাস, রোমের ইতিহাস প্রভৃতি ।
হিন্দি ভাষার উন্নতির জন্য তিনি অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছিলেন । স্কুল পরিদর্শক থাকাকালীন বিহারে বহু হিন্দি স্কুল স্থাপন , বাংলা বইয়ের হিন্দি অনুবাদ প্রকাশ ও মূল হিন্দি বই লেখায় তিনি সচেষ্ট ছিলেন । তাঁরই প্রস্তাবে বিহারের আদালতে ফারসির পরিবর্তে হিন্দি ব্যবহার শুরু হয় । সংস্কৃত ভাষার উন্নতির জন্য তিনি তাঁর পিতার নামে বিশ্বনাথ ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছিলেন এবং চতুষ্পাঠীর শিক্ষকদের বৃত্তিদান করতেন। এছাড়াও বিশ্বনাথ চতুষ্পাঠী এবং মায়ের নামে ব্রহ্মময়ী ভেষজালয় স্থাপন করেছিলেন । ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে তিনি বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সভ্য ছিলেন ।
গদ্যরীতিঃ ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের গদ্য বিশেষভাবে প্রশংসনীয় । তাঁর নিবন্ধের গদ্যভাষা সমকালেই যথেষ্ট সমাদৃত হয়েছিল , তাঁর যুক্তিবাদ এবং দার্শনিক প্রত্যয়ের প্রতি সকলেই ভীষণভাবে আকৃষ্ট হয়েছিল । তাঁর ভাষা তাঁর ব্যক্তিত্বের মতোই সহজ-সরল , বাহুল্যহীন , গম্ভীর । এই ভাষা রসসাহিত্যের সহায়ক না হোক তা নিঃসন্দেহে জ্ঞাননিষ্ট প্রবন্ধের উপযোগী এবং যুক্তিযুক্ত ।
তাঁর “ঐতিহাসিক উপন্যাস”এ বঙ্কিমচন্দ্রের দূরশ্রুত পদধ্বনি শোনা যায় :- ” একদা কোন অশ্বারোহী পুরুষ গান্ধার দেশের নির্জন বনে ভ্রম করিতেছিলেন । ক্রমে দিনকর গগনমন্ডলের মধ্যবর্তী হইয়া খরতর কিরণ-নিকর বিস্তার দ্বারা ভূতল উওপ্ত করিলে পথিক অধ্বভ্রমে ক্লান্ত হইয়া অশ্বকে তরুণ তৃণ ভক্ষণার্থ রজ্জু মুক্ত করিয়া দিলেন এবং আপনি সমীপবর্ত্তী নির্ঝর তীরে উপবিষ্ট হইয়া চতুর্দিকে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন ।”
এইভাবে , ভূদেব বাবু ঊনবিংশ শতাব্দীর শিক্ষাবিদ , সম্পাদক , ঔপন্যাসিক প্রাবন্ধিক হিসেবে বাংলা গদ্যসাহিত্যের ধারায় চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন ।
মৃত্যুঃ ১৮৯৪ খ্রীস্টাব্দের ১৫ই মে ভূদেব বাবু পরলোকে পাড়ি দেন ।
তথ্যসূত্রঃ ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের “বাংলা সাহিত্য পরিচয় ও সাহিত্যটীকা” এবং ইন্টারনেট।
আলোচকঃ সাহেব দাঁ, পুরুলিয়া, পশ্চিমবঙ্গ।