কালীপ্রসন্ন সিংহ – বাংলা সাহিত্যের ‘হুতোম’
সাহিত্যিক, শিক্ষানুরাগী এবং সমাজ সংস্কারক কালীপ্রসন্ন সিংহ একাধারে লেখক ও সমাজসেবক ছিলেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন তাঁর মহাভারত অনুবাদ এবং ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’র জন্য। শুধু সাহিত্য রচনাই নয়, এর পাশাপাশি তিনি লোকহিতে বা সমাজসেবাতেও নানা কাজ করে গেছেন। আমাদের এই আলোচনায় কালীপ্রসন্ন সিংহ -এর এই দিকগুলি নিয়েই আলোকপাত করা হয়েছে।
শৈশব, শিক্ষা এবং জীবন
কালীপ্রসন্ন সিংহ -এর জন্ম কোন দিনটিতে এ নিয়ে সামান্য মতবিভেদ আছে। কেউ বলেন তাঁর জন্ম তারিখটি হল ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৮৪০ আবার কেউ বলেন, ২৪ শে ফেব্রুয়ারি ১৮৪০। তিনি উত্তর কলকাতার সিংহ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম নন্দলাল সিংহ। মাত্র ছয় বছর বয়সে তিনি পিতৃহারা হলে তৎকালীন নিম্ন আদালতের বিচারক হরচন্দ্র ঘোষ মহাশয়ের কাছে তিনি পালিত হন।
১৮৫৪ খ্রিঃ বাগবাজারের লোকনাথ বসুর কন্যার সাথে তাঁর বিবাহ হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মাত্র কয়েক বছর পরেই তাঁর স্ত্রীবিয়োগ ঘটে। এরপর তিনি দ্বিতীয় বিবাহ করেন শরৎকুমারী দেবীকে।
কালীপ্রসন্ন তৎকালীন হিন্দু কলেজের ছাত্র ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি উক্ত কলেজ পরিত্যাগ করে স্বগৃহেই নানা ভাষা চর্চায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। তাঁর ইংরেজি বিষয়ক গৃহশিক্ষক ছিলেন মিঃ প্যাট্রিক। অল্প সময়েই তিনি একজন সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত হতে শুরু করেন। পাশাপাশি পত্রিকার সম্পাদনাও করেন। একজন সমাজসেবী হিসেবেও তাঁর পরিচিতি ছিল। মাত্র ৩০ বছর বয়সে ২৪ শে জুলাই ১৮৭০ খ্রিঃ তিনি পরলোকগমন করেন।
সাহিত্যজীবন ও সমাজসেবা
মাত্র তেরো বছর বয়সে তিনি বাংলাভাষা চর্চার জন্য ‘বিদ্যোৎসাহিনী সভা’র প্রতিষ্ঠা করেন। এই সভার প্রতিষ্ঠা হয় আনুমানিক ১৮৫৫ খ্রিঃ। উক্ত সভার সভ্য হিসেবে যুক্ত ছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র, কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য, রাধানাথ শিকদারের মত ব্যক্তিত্ব। এই সভার পক্ষ থেকে বাংলায় কাব্যরচনার জন্য মাইকেল মধুসূদন দত্তকে এবং নীলদর্পণ অনুবাদ প্রকাশ করবার জন্য লঙ্ সাহেবকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। নীলদর্পণ অনুবাদ প্রকাশ করবার জন্য লঙ্ সাহেবের হাজার টাকা জরিমানা হয়েছিল যা কালীপ্রসন্ন সিংহ মিটিয়ে দিয়েছিলেন। এই সভার মুখপত্র বিদ্যোৎসাহিনী পত্রিকা ছাড়াও সর্বতত্ত্ব প্রকাশিকা, বিবিধার্থ সংগ্রহ, পরিদর্শক প্রভৃতি পত্রিকা তিনি সম্পাদনা করতেন।
তাঁর সবথেকে বড় কীর্তি আঠারো পর্ব মহাভারতের গদ্য অনুবাদ। মাত্র আঠারো বছর বয়সে তিনি মহাভারত অনুবাদ করতে শুরু করেন। কয়েকজন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর -এর সাহায্যে দীর্ঘ আট বছর পরিশ্রমের পর অনুবাদ শেষ করেন। এই অনুবাদটি ১৮৫৮ থেকে ১৮৬৬ এর ভিতরে প্রকাশিত হয়েছিল। প্রতিটি তিন হাজার কপি করে ছাপিয়ে বিনামূল্যে বিতরন করেছেন। এমনকি ডাক মাশুল পর্যন্ত তিনিই দিয়ে দিতেন। তিনি বহুবিবাহ রোধ এবং বিধবাবিবাহ প্রচলনের জন্য পুরস্কার প্রদান করতেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য তাঁর এই মহাভারত মহারাণী ভিক্টোরিয়াকে উৎসর্গ করা হয়েছিল।
কয়েকটি নাটক রচনা করার পর কালীপ্রসন্ন হুতোম প্যাঁচার নক্শা রচনা করেন ১৮৬২ খ্রীষ্টাব্দে। তৎকালীন কলকাতার আচার ব্যবহার, পালা-পার্বণ, সভা-সমিতি প্রভৃতি সামাজিক উৎসব এবং নানা ঘটনা হুতোম প্যাঁচার নক্শায় সরসরি ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। হুতোম প্যাঁচার নক্শা ছিল কথ্য ভাষায় লেখা প্রথম বাংলা বই। এই বইতে কোন কোন মান্য ব্যক্তির প্রতি কটাক্ষ করা হয়েছিল তাই এর প্রতিবাদে একই রকমের দু-একটি বই লেখা হয়েছিল।
পত্রিকা সম্পাদনা
বাংলা সাহিত্য ও সমাজের প্রয়োজনে কালীপ্রসন্ন সিংহ কয়েকটি পত্রিকার সম্পাদনা ও প্রকাশনা করতেন। যেমন ‘বিদ্যোৎসাহিনী পত্রিকা’, ‘পরিদর্শক’, ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’ ইত্যাদি। ‘বিদ্যোৎসাহিনী পত্রিকা’র প্রথম প্রকাশ ১৮৫৫ খ্রিঃ ২০ এপ্রিল। প্রতি সংখ্যায় পৃষ্ঠা পরিমাণ ছিল ১০। ‘পরিদর্শক’ পত্রিকাটি যদিও জগন্মোহন তর্কালংকার ও মদনমোহন গোস্বামীর সম্পাদনায় প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৬১ খ্রিঃ জুলাই মাস নাগাদ। কিন্তু পত্রিকাটির ক্ষুদ্র কলেবর চাহিদা অনুসারে যেন তৃপ্তি আনতে পারছিল না। অবশেষে ১৮৬২ খ্রিঃ এই পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন কালীপ্রসন্ন এবং তাঁর পরিচালনায় পত্রিকাটির শ্রীবৃদ্ধি হতে শুরু করে। ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’ প্রথম প্রকাশ পায় ১৮৫১ খ্রিঃর অক্টোবর মাস নাগাদ রাজেন্দ্রলাল মিত্রের সম্পাদনায়। এরপর ১৮৬১ খ্রিঃ এই পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব নেন কালীপ্রসন্ন সিংহ।
গ্রন্থতালিকা
বাবুনাটক (১৮৫৪), বিক্রমোর্বশী নাটক (১৮৫৭), সাবিত্রী-সত্যবান নাটক (১৮৫৮), মালতী-মাধব নাটক (১৮৫৯), হুতোম প্যাঁচার নকশা (১৮৬১), কালীসিংহীর মহাভারত (১৮৫৮-৬৬)