
প্যারীচাঁদ মিত্র – অজানা নানা তথ্য
প্যারীচাঁদ মিত্র বাংলা গদ্যের ইতিহাসে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় রেখে গেছেন। তিনি জনকল্যাণের জন্যই কলম ধরেছিলেন, স্ত্রীসমাজের সর্বাঙ্গীণ উন্নতি ছিল তাঁর একমাত্র আকাঙ্ক্ষা। তিনি কেবল সাহিত্য সৃষ্টিই নয়, পত্রিকা সম্পাদনাতেও যুক্ত ছিলেন। লেখকের গদ্য রচনা সম্পর্কে জানতে আমাদের এই পোস্টটি দেখুন। আমরা প্যারীচাঁদ মিত্র – অজানা নানা তথ্য পোস্টে লেখকের জীবন ও সাহিত্য সম্পর্কিত নানা খুঁটিনাটি তথ্য পরিবেশন করেছি। তথ্যগুলি সাধারণ পাঠক-পাঠিকা ছাড়াও SLST বা PSC পরীক্ষার্থীদেরও কাজে লাগবে।
প্যারীচাঁদ মিত্র – জীবনকেন্দ্রিক তথ্য
জন্ম – ২২ জুলাই, ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দ (৮ শ্রাবণ, ১২২১ বঙ্গাব্দ) কলকাতায়
পিতা – রামনারায়ণ মিত্র
শিক্ষা – হিন্দু কলেজ (১৮২৭)
দাম্পত্যসঙ্গী – বামাকালী দেবী (ইনি খড়দহের প্রাণকৃষ্ণ বিশ্বাসের কন্যা ছিলেন)
পুত্র – হীরালাল মিত্র, চুনিলাল মিত্র
ব্যবসা – ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে ‘প্যারীচাঁদ মিত্র এন্ড সন্স’ দ্বারা আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা
ছদ্মনাম – টেকচাঁদ ঠাকুর
উপনাম – ডিকেন্স অফ বেঙ্গল (পাদরি লঙ সাহেব বলতেন)
সম্পাদনা – মাসিক পত্রিকা (১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে, রাধানাথ শিকদারের সহযোগে)
মৃত্যু – ২৩ নভেম্বর, ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দ
সম্মান – মিউনিসিপ্যাল বোর্ডের ম্যাজিস্ট্রেট (১৮৬৩), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো (১৮৬৪), বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য (১৮৭০)। এছাড়া কলকাতা টাউন হলে তাঁর একটি আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করা হয় ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের ৫ই জানুয়ারি।
গ্রন্থাবলী
আলালের ঘরের দুলাল (১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দ বা ১২৬৪ বঙ্গাব্দ), মদ খাওয়া বড় দায় জাত থাকার কি উপায় (১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দ বা ১২৬৬ বঙ্গাব্দ), রামারঞ্জিকা (১৮৬০), কৃষিপাঠ (১৮৬১), গীতাঙ্কুর (১৮৬১), যৎকিঞ্চিৎ (১৮৬৫), অভেদী (১৮৭১), ডেভিড হেয়ারের জীবন চরিত (১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দ বা ১২৮৫ বঙ্গাব্দ), এতদ্দেশীয় স্ত্রীলোকদিগের পূর্ব্বাবস্থা (১৮৭৯), আধ্যাত্মিকা (১৮৮০ খ্রিস্টাব্দ বা ১২৮৬ বঙ্গাব্দ), বামাতোষিণী (১৮৮১ খ্রিস্টাব্দ বা ১২৮৮ বঙ্গাব্দ)
ইংরেজি গ্রন্থ – The Spiritual Stray Leaves (1879), Life of Dewan Ramcomul Sen (1880), Life of Colesworthy Grant (1881), On the Soul: Its nature and development (1881), Agriculture in Bengal (1881)
সংক্ষিপ্ত আলোচনা
১. আলালের ঘরের দুলাল
রচনাটি টেকচাঁদ ঠাকুর ছদ্মনামে ‘মাসিক’ পত্রিকায় ১৮৫৫ খ্রিঃ থেকে প্রকাশিত হয়। রচনাটি বাংলা উপন্যাসের পথকে সুগম করেছিল। এতে আছে গল্প ও সমাজচিত্র। লেখক এই গ্রন্থে চলিত কথ্যভাষা ব্যবহার করেছেন যা ‘আলালী ভাষা’ নামে পরিচিতি লাভ করে। সমগ্র রচনাটি তিরিশটি অধ্যায়ে বিভক্ত। প্রধান চরিত্রগুলি হল বাবুরাম, মতিলাল, ঠকচাচা, বাঞ্ছারাম।
‘আলালের ঘরের দুলাল’ ইংরেজিতে প্রথম অনুবাদ করেন নরেন্দ্রনাথ মিত্র। অনুবাদ কাজে তাঁকে সাহায্য করেন মিরিয়ম এস নাইট। অনুবাদটি ‘The Spoilt Child’ নামে Journal of the National Indian Association পত্রিকায় ১৮৮২ – ৮৩ খ্রিস্টাব্দে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। এছাড়া ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে জি. ডি. অসওয়েল ‘The Spoilt Child: A Tale of Hindu Domestic Life’ নামে একটি স্বতন্ত্র ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেন।
১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে ‘আলালের ঘরের দুলাল’ –এর নাট্যরূপ দেন হীরালাল মিত্র। সেটি ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে বেঙ্গল থিয়েটারে অভিনীত হয়।
২. আধ্যাত্মিকা
এটিকে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন ‘নারীকল্যাণমূলক উপন্যাস’। লেখকও গ্রন্থের ভূমিকায় জানিয়েছেন, বিশেষ ভাবে হিন্দু নারীদের জন্যই উপন্যাসের আকারে এই রচনাটি তিনি উপস্থাপিত করেছেন। হরদেব ও তার স্ত্রীর প্রচুর বিষয়-সম্পত্তি থাকলেও তাদের ঐহিক সম্পত্তিতে কোনো বাসনা ছিল না। এক সময় হরদেব জানতে পারেন সুন্দরবনে তাদের জমিদারি বন্যা-প্লাবিত হয়েছে। প্রজাদের ঘর-বাড়ি প্লাবিত, অনেক গোরু মারা গেছে, ফসল নষ্ট হয়েছে। তারা দু’জনেই দুঃখীদের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করেন। তাদের এক কন্যা ছিল – আধ্যাত্মিকা। সে যেমন শাস্ত্রজ্ঞ তেমনি দয়ালু। সামাজিক কল্যাণই ছিল তার ধ্যানজ্ঞান। সেই সমাজসেবাই হল তার বিশিষ্ট আধ্যাত্মিক দিক।
প্যারীচাঁদ মিত্র – অজানা নানা তথ্য
১. ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভার যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র
২. ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল ব্রিটিশ ইণ্ডিয়া স্যোসাইটির অবৈতনিক সম্পাদক ছিলেন তিনি।
৩. ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত বীটন স্যোসাইটির অবৈতনিক সম্পাদক ছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র।
৪. ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে পশুক্লেশনিবারণী সভার অবৈতনিক সম্পাদক ছিলেন তিনি।
৫. ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গদেশীয় সামাজিক বিজ্ঞান সভার যুগ্ম অবৈতনিক সম্পাদক ছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র।
৬. প্যারীচাঁদ মিত্র তাঁর Agriculture in Bengal গ্রন্থে তামাকের উৎপত্তি সম্পর্কে লিখেছেন।
৭. প্যারীচাঁদই প্রথম বাঙালি যিনি ‘এগ্রিকালচারাল এন্ড হর্টিকালচারাল স্যোসাইটি’র ‘অনরারি মেম্বর’ নির্বাচিত হয়েছিলেন।
৮. ‘রামারঞ্জিকা’ গ্রন্থে লেখক স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক কথোপকথনের মাধ্যমে স্ত্রীলোকদের সাংসারিক বিষয়ে উপদেশ দিয়েছেন।
৯. প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘গীতাঙ্কুর’ ব্রহ্ম-বিষয়ক ৩৫টি গানের সমষ্টি।
১০. ‘অভেদী’ একটি আধ্যাত্মিক উপন্যাস যাতে নানা দুঃখ-বেদনার মধ্য দিয়ে পরমার্থ লাভের কথা বলা হয়েছে।
১১. প্রাচীন মহীয়সী নারীর জীবনকথা বলা হয়েছে ‘এতদ্দেশীয় স্ত্রীলোকদিগের পূর্ব্বাবস্থা’ গ্রন্থটিতে।
১২. নীতিকথা ও সৎ শিক্ষা দেওয়া হয়েছে প্যারীচাঁদের ‘বামাতোষিণী’ গ্রন্থে।
আলোচক – নীলরতন চট্টোপাধ্যায়
তারিখ – ২৭.০৭.২০২৫