সনেট – কিছু জরুরী তথ্য
মন্ময় কবিতার একটি বিশিষ্ট ভাগ সনেট জাতীয় কবিতার জন্ম হয় ইতালিতে নবজাগরণের যুগসন্ধিতে চতুর্দশ শতাব্দীতে। ইতালিয় কবি পের্ত্রাক হলেন সনেটের প্রকৃত প্রবর্তক বা জন্মদাতা।
তবে সনেটের প্রথম প্রবর্তক হিসাবে পিয়ারাভনের নামও পাওয়া যায়। এ নিয়ে সন্দেহ থাকায় পেত্রাককেই সনেটের জন্মদাতা বলা হয়। সিসিলীয় কবি সুইডেন প্রথম সনেটের নিয়ম কানুন প্রবর্তন করেন ও অষ্টক ষটক ভাগ করেন। বিখ্যাত সনেট রচয়িতা দান্তে ও ট্যাসো ছিলেন পের্ত্রাকের অনুসারী। বাংলা ভাষায় সনেটের জন্মদাতা মাইকেল মধুসূদন দত্ত।
সনেট (Sonnet) এর অর্থ :– ইংরাজী ‘Sonnet’ শব্দটি ইতালীয় শব্দ ‘Sonetto’ থেকে আগত। যায় অর্থ ‘Little sound or song’ , ‘মৃদুধ্বনি’।
সনেটের সংজ্ঞা
১.অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচিত,অন্ত্যমিল বিন্যাসের বিশিষ্ট আদর্শে গঠিত, ১৪ মাত্রার বা ১৮ মাত্রার চরণের যে বিশেষ ছন্দ বন্ধের মধ্যে প্রথম ৮ চরণে একটা ভাব প্রকাশিত হয় এবং পরের ৬ চরণে তার বিশ্লেষণ থাকে অর্থাৎ মিলের একটা আদর্শ অনুসরণ করা হয় তাকে সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতা বলা হয়।
২.ইংরেজ কবি কোলরিজ সনেট সম্বন্ধে বলেছেন— ‘A small poem, in which some lonely feelings is developed’.
৩.সমদৈর্ঘ্যের চোদ্দটি পংক্তিতে ও একটি বিশেষ ছন্দরীতিতে যখন কবিমনের একটি অখণ্ড ভাবকল্পনা কাব্যরূপ লাভ করে তখন তাকে সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতা বলা যেতে পারে।
সনেটের সাধারন বৈশিষ্ট্য
১. সনেট অক্ষরবৃত্ত রীতিতে রচিত পয়ার ও মহাপয়ারের উপর স্থাপিত।
২. সনেটে থাকে ১৪ টি চরণ।
৩. পয়ারের উপর প্রতিষ্ঠিত সনেটে প্রতিটি চরণে থাকে ১৪ টি মাত্রা যার প্রবর্তক হলেন মধুসূদন দত্ত । যথা– ‘বঙ্গভাষা’।
৪. মহাপয়ারের উপর প্রতিষ্ঠিত সনেটে প্রতিটি চরণে থাকে ১৮ টি মাত্রা যার প্রবর্তক হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যথা ‘রাত্রি’।
৫. সনেটের প্রথম ৮ চরণকে বলে ‘অষ্টক’, শেষের ৬ চরণকে বলে ‘ষটক’।
৬. অষ্টকে একটা ভাব ঘণীভূত হয়ে প্রকাশ পায় আর ষটকে তা ব্যাখ্যা থাকে।
৭. সনেটে অষ্টক মূল,ষটক উপসংহার।
৮. মিলবিন্যাসের দিক দিয়ে সনেটকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়—-
ক. পেত্রার্কীয় সনেট – অষ্টকের মিলবিন্যাস – কখ খক, কখ খক । ষটকের মিলবিন্যাস – গঘঙ,গঘঙ / গঘগ,ঘগঘ / গঘঙ,ঘগঙ।
খ. শেক্সপীয়রীয় সনেট – তিনটি চতুষ্ক ও একটি সমিল দ্বিপদিকা এই সনেটে বিদ্যমান। মিলবিন্যাস – কখ কখ,গঘ গঘ,ঙচ ঙচ,ছছ।
গ. ফরাসি সনেট – অষ্টকের মিলবিন্যাস– কখ কখ, কখ কখ। ষটকের মিলবিন্যাস– গঘ, কগ খঘ।
৯. সনেটে ভাব প্রকাশের মধ্য দিয়েই কবি হৃদয়ের গভীর আনন্দ বা বেদনা বা বিশেষ অনুভূতি ব্যক্ত হয়।
১০. সনেট গাঢ়বদ্ধ রচনা, তার দেহ সংহত এবং মিতায়তন।
১১. সনেটে একটি মাত্র ভাবের দ্যোতনা লক্ষ করা যায়।
১২. সনেট রচয়িতার কঠিন পরিমিতি বোধ কাম্য।
১৩. সনেটের ভাষা হবে স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল যাতে কোনো দুর্বোধ্যতা থাকবেনা।
১৪. সনেট অক্ষরবৃত্তে রচিত বলে এর যাবতীয় লক্ষণ সনেটে প্রতিফলিত হতে দেখা যায়।
সনেটের শ্রেণিবিভাগ ও গঠন
সনেট মূলত দু’ প্রকারের। ১.পেত্রার্কীয় সনেট। ২.শেক্সপীয়রীয় সনেট। তবে এডমান্ড স্পেনসার শেক্সপীয়রীয় সনেটে নতুনত্ব এনেছেন। তাঁর প্রবর্তিত সনেটকে বলে – ৩.স্পেনসারের সনেট। এছাড়া ফ্রান্সে নতুন রীতির একটি সনেট গড়ে উঠেছে, সেটি হল – ৪.ফরাসি সনেট।
১. পেত্রার্কীয় সনেটের গঠন
ক. পেত্রার্কীয় সনেট ১৪ পংক্তির হয়। প্রথম ৮ পংক্তিকে ‘অষ্টক’ এবং পরবর্তী ৬ পংক্তিকে ‘ষটক’ বলে। অষ্টক দুটি চতুষ্ক এবং ষটক দুটি ত্রিপদিকা নিয়ে গঠিত।
খ. অষ্টক অংশে প্রশ্ন কিংবা বিবরণের মাধ্যমে কবিতার মূল ভাববস্তুর আভাস দেওয়া হয় আর ষটক পর্বে সে প্রশ্নের বা অবতারণার উত্তর বা সমাপ্তি সূচিত হয়।
গ. এই সনেটে কখনও অষ্টক ও ষটক পৃথকভাবে অবস্থান করে আবার কখনও এক অবিভক্ত কবিতারূপে সনেটের সমগ্র গঠনটি পরিস্ফূট হয়।
ঘ. এই রীতির সনেটের মিলবিন্যাস রীতি – অষ্টক অংশের মিল বিন্যাস হল কখ কখ, কখ কখ। ষটক অংশের মিলবিন্যাসে বৈচিত্র লক্ষ্য করা যায় – গঘঙ গঘঙ / গঘগ ঘগঘ / গঘঙ ঘগঙ।
ঙ. পেত্রার্কীয় সনেটের উদাহরণ –
‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’– জীবনানন্দ দাশ।
‘আকাশে সাতটি তারা’– জীবনানন্দ দাশ
‘আবার আসিব ফিরে’– জীবনানন্দ দাশ
‘এখানে আকাশ নীল’–জীবনানন্দ দাশ
একটি পেত্রার্কীয় সনেটের বিশ্লেষণ
বসন্তের আগমনে / আরো আছে দেরি, ক
পর্বতের স্তরে স্তরে / বিরাজে তুষার। খ
চুরি করে ফিকে রং / গোলাপী ঊষার। খ
লাজমুখে ফুটিয়াছে / ঝাঁকে ঝাঁকে চেরি। ক
পত্রহীন শাখাগুলি / ফেলিয়াছে ঘেরি, ক
বসিয়া তাহার অঙ্গে / কুসুম আসার। খ
সে জানে,যে বোঝে অর্থ / ফুলের ভাষার, খ
বসন্তের ঘোষণার / তুমি রত্নভেরী। ক
(অষ্টক)
মর্মর কঠিন শুভ্র / তুষারের গায়ে, গ
পড়েছে রূপের তব / রঙীন আলোক। ঘ
পূর্বরাগে লিপ্ত তব / কর পরশনে, ঙ
শিশিরে বসন্ত স্মৃতি / তুলেছে জাগায়ে। গ
রক্তিম আভায় যেন / ভরিয়া ত্রিলোক, ঘ
শোভিছে উমার মুখ / শিব দর্শনে। ঙ
(ষটক)
এই কবিতার প্রতি চরণের মাত্রা বিন্যাস ৮+৬। অষ্টকের ও ষটকের মিলবিন্যাস পেত্রার্কীয় সনেটের অনুরূপ।
২. শেক্সপীরীয় সনেটের গঠন
ক. শেক্সপীয়রীয় সনেট ১৪ পংক্তির তিনটি চতুষ্ক ও একটি সমিল দ্বিপদিকা নিয়ে গঠিত।
খ. এই সনেটে মেজাজ বদল ঘটে শেষের সমিল দ্বিপদিকায়।
গ. মিলবিন্যাস রীতি হল কখ কখ, গঘ গঘ, ঙচ ঙচ, ছছ।
একটি শেক্সপীয়রীয় সনেটের বিশ্লেষণ
সে আমার শুভ্র নয় / হেমানীর মত ক
ওষ্টাধরে বিশ্বফল / লজ্জা নাহি পায়, খ
হেরি তার ভুরু দুটি / ধনু করি নত ক
অনঙ্গ বিনম্র শির / ফেরে না ধরায়। খ
(মাত্রা বিন্যাস ৮+৬। প্রথম চৌপদী)
আঁখি দুটি সকরুণ / ললাট ফলকে গ
স্ফটিক নির্মল দীপ্তি / করে না প্রকাশ ঘ
নবোদ্ভিন্ন দন্তপংক্তি / উজ্জ্বল ঝলকে গ
মহার্ঘ মুকুতা নাহি / করে উপহাস। ঘ
(মাত্রা বিন্যাস ৮+৬। দ্বিতীয় চৌপদী)
আজো তার তনুখানি / পুষ্পহীন লতা ঙ
বনের শৈশব টুকু / ধুলিতে সলিল চ
কত ভুলে ভরা তার / দুচারিটি কথা, ঙ
আধ শেখা গীতসম / মাধুরী বিহীন। চ
(মাত্রা বিন্যাস ৮+৬। তৃতীয় চৌপদী)
শুধু সে আমার পতি / আপনার ধন ছ
এত দেখে শুনে তাই / তৃপ্ত নহে মন। ছ
(মাত্রা বিন্যাস ৮+৬। এটি সমিল দ্বিপদী)
৩. স্পেনসারের সনেটের গঠন
এডমান্ড স্পেনসারের সনেট শেক্সপীয়রীয় সনেটের অনুসারী। শুধু তিনি মিলবিন্যাসে নতুনত্ব এনেছেন। তিনি তাঁর ‘অ্যামোরেটি’ (Amorctti) কাব্যে তিনটি চতুষ্কের মধ্যে পারস্পরিক যোগসূত্র স্থাপন করেন। তাঁর সনেটের মিলবিন্যাস হল – কখ কখ, খগ খগ, গঘ গঘ, ঙঙ।
৪. ফরাসি সনেটের গঠন
পেত্রার্কীয় সনেটের সাথে ফরাসি সনেটের মিল আছে। ফরাসি সনেট পেত্রার্কীয় সনেটের মতো অষ্টক ও ষটকে বিভক্ত। অষ্টকের মিলবিন্যাস পেত্রার্কীয় সনেটের মতোই কিন্তু পেত্রার্কীয় সনেটে ষটক যেখানে দুটি ত্রিপদিকাতে বিভক্ত সেখানে ফরাসি সনেটে ষটক একটি দ্বিপদিকা ও একটি চতুষ্কে বিভক্ত। এই সনেটের মিল বিন্যাস হল – কখ খক, কখ খক, গগ, ঘঙ ঘঙ।
একটি ফরাসি সনেটের বিশ্লেষণ
সে যে জেগেছিল মোর / বাঁশীর সুরে, ক
আমার নয়ন পাতে / ফুটেছিল রূপে। খ
পরশে সঙ্কোচ ছিল / কথা চুপে চুপে, খ
দৃষ্টি ছিল কল্পলোকে / কোথায় সুদূরে। ক
সেই রজনীটি মোর / এই সত্য পুরে ক
পরিশ্রান্ত মিলনের / তীব্র গন্ধরূপে খ
মিশিল আজিকে কোথা / স্মৃতি অন্ধ কূপে খ
হারানু কবে না জানি / ক্ষণিকা বধূরে। ক
(অষ্টক। মাত্রা ৮+৬)
মুহূর্তের জ্বালা শুধু / যে গিয়েছে যাক্ গ
অতীতের বাঁধা বীণা / রহুক নির্বাক। গ
(সমিল দ্বিপদীকা। মাত্রা ৮+৬)
আমার মানস কুঞ্জে / আমি জানি তবু ঘ
ব্যর্থ হয় নাই সেই / অভিসার রাতি ঙ
মানসী প্রিয়া সে মোর / ভোলে নাই কভু ঘ
জ্বলিয়া রেখেছে চির / মিলনের বাতি। ঙ
(চতুষ্ক। মাত্রা ৮+৬)
পেত্রার্কীয় সনেটের সাথে শেক্সপীয়রীয় সনেটের পার্থক্য
১. পেত্রার্কীয় সনেট ১৪ পংক্তির, তাতে একটা অষ্টক ও একটি ষটকে বিভক্ত কিন্তু শেক্সপীয়রীয় সনেট ১৪ পংক্তির, সেটি তিনটি চতুষ্ক ও একটি সমিল দ্বিপদীকাতে বিভক্ত।
২. পেত্রার্কীয় সনেটে অষ্টক থেকে ষটকে যাওয়ার সময় কবিতার মেজাজ বদল (Volta) ঘটে কিন্তু শেক্সপীয়রীয় সনেটে শেষের সমিল দ্বিপদীকাতে এই মেজাজ বদল ঘটে।
৩. পেত্রার্কীয় সনেটের মিল বিন্যাস কখ খক। কখ খক (অষ্টক) গঘঙ গঘঙ / গঘগ ঘগঘ / গঘঙ ঘগঙ (ষটক)
পেত্রার্কীয় সনেটের সাথে ফরাসি সনেটের পার্থক্য
পেত্রার্কীয় সনেটে শেষ স্তবকের ষটক দুটি ত্রিপদীকা অংশে বিভক্ত কিন্তু ফরাসি সনেটে ষটক অংশটি ২+৪ অর্থাৎ একটা দ্বিপদিকা ও একটি চতুষ্কে বিভক্ত।
বাংলা কাব্যজগতের কয়েকটি সনেট সংকলন গ্রন্থ
১. “চতুর্দশপদী কবিতাবলী” (১৮৬৬ খ্রিঃ) – মাইকেল মধুসূদন দত্ত।
২. “নৈবেদ্য” (১৯০২ খ্রিঃ) ও “চৈতালী” (১৮৯৬ খ্রিঃ) – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
৩.“সনেট পঞ্চাশৎ” (১৯১৩ খ্রিঃ) – প্রমথ চৌধুরী।
৪. “অশোক সঙ্গীত” (১৯১৪ খ্রিঃ) ও “জীবনপথে” (১৯৩০ খ্রিঃ) – কামিনী রায়।
৫. “রূপসী বাংলা” (১৯৫৭ খ্রিঃ) – জীবনানন্দ দাশ।
৬. “চতুর্দশপদী কবিতাবলী” (১৯৭০ খ্রিঃ) – শক্তি চট্টোপাধ্যায়।
সনেট কবিতা সম্পর্কিত পরিভাষা
১. অষ্টক (Octave) – সনেটের ৮ পংক্তি নিয়ে অষ্টক গঠিত।
২. ষটক (Sestet) – সনেটের ৬ পংক্তি নিয়ে ষটক গঠিত।
৩. চতুষ্ক (Quatrain) – সনেটের ৪ পংক্তি নিয়ে চতুষ্ক গঠিত।
৪. ত্রিপদীকা (Tercet) – সনেটের ৩ পংক্তি নিয়ে ত্রিপদিকা গঠিত।
৫. সমিল দ্বিপদীকা (Rhymed couplet) – এটি সনেট জাতীয় কবিতার স্তবক বিন্যাসের একটি পদ্ধতি যাতে দুটি পংক্তি একটি স্তবকে বিন্যস্ত থাকে এবং যাদের প্রতি পংক্তির শেষে মিল বর্তমান।
৬. ভোল্টা (Volta) – পেত্রার্কীয় সনেটে অষ্টক থেকে ষটকে যাওয়ার সময় কবিতার মেজাজ বদল লক্ষ্য করা যায়। একে ভোল্টা বলে। শেক্সপীয়রীয় ও স্পেনসারের সনেটে শেষ সমিল দ্বিপদীকাতে ভোল্টা লক্ষ্য করা যায়। এক কথায় ভোল্টা হল কবিতার মেজাজ বদল।
সনেট সম্পর্কিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাবলী
১. সনেটের বাংলা পরিভাষা ‘চতুর্দশপদী কবিতা’ মাইকেল মধুসূদন দত্ত কৃত।
২. শেক্সপীয়রীয় এবং স্পেনসারের সনেটে শেষ সমিল দ্বিপদীকাতে (Rhymed couplet) কবিতার মেজাজ বদল (Volta) লক্ষ্য করা যায়।
৩. বাংলা ভাষায় সনেটের জনক মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তিনি ফ্রান্সের ভরসেলস্ শহরে সনেট রচনা করেন। সেগুলি ১৮৬৬ খ্রিঃ ১ আগষ্ট (১২৭৩ বঙ্গাব্দ) কলকাতা থেকে “চতুর্দশপদী কবিতাবলী” নামে প্রকাশিত হয়। প্রকাশকের নাম ঈশ্বরচন্দ্র বসু। সংকলনটিতে মোট সনেটের সংখ্যা ১০২ টি। এছাড়া মধুসূদন আরও ৭ টি সনেট রচনা করেছিলেন। সংকলনটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে। মধুসূদন দত্ত সনেট রচনার প্রেরণা পান ইতালীয় কবি পেত্রার্কের থেকে। মধুসূদন দত্ত পেত্রার্কীয় এবং শেক্সপীয়রীয় উভয় রীতির বহু সার্থক সনেট রচনা করেছেন। অনেক সময় উভয় রীতির মিশ্রণ ঘটিয়েছেন।
৪. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পেত্রার্কীয় বা শেক্সপীয়রীয় কোনো রীতির সনেট অবলম্বনে সনেট রচনা করেননি। তিনি সনেট রচনার ক্ষেত্রে স্বকীয়তা ও বৈচিত্র্যের পরিচয় রেখেছেন।
৫. প্রমথ চৌধুরী বাংলা সনেট রচনার ক্ষেত্রে অভিনবত্বের ছাপ রেখেছেন। তিনি পেত্রার্কীয় রীতির সাথে ফরাসি ধাঁচের মিশ্রণ ঘটিয়েছেন। প্রমথ চৌধুরী নিজেই বলেছেন – “আপনি ঠিকই ধরেছেন, আমি ফরাসী ছাঁচই অবলম্বন করেছি।…… ফরাসীরা ষটককে দুই ভাগ করেছেন। প্রথম একটি দ্বিপদী, পরে একটি চতুষ্পদী।…… ফরাসী সনেট গড়া অনেক অপেক্ষাকৃত সহজ। তাই আমি ঐ Form টাই নিই।” প্রমথ চৌধুরী তাঁর “সনেট পঞ্চাশৎ” (১৯১৩ খ্রিঃ) নামক সনেট সংকলন গ্রন্থে সনেট সম্বন্ধে বলেছেন — “ভালোবাসি সনেটের কঠিন বন্ধন, শিল্পী যাহে মুক্তি লভে অপরে ক্রন্দন।”
৬. মোহিতলাল মজুমদার ১৮ মাত্রার সনেট লিখেছেন।
৭. ইংরাজী সাহিত্যে জর্জ মেরেডিথ তাঁর “Modern Love” কাব্যে ১৬ পংক্তির সনেট রচনা করেছেন।
৮. ইংরেজ কবি হপকিন্স ৬ ও ৪ পংক্তির বিভাজনে মোট ১০ পংক্তির সনেট লিখেছেন।
৯. সনেট জাতীয় কবিতায় একটা মাত্র ভাবের দ্যোতনাকে ১৪টি পংক্তির নির্মাণ রীতিতে ভাষা ও শৈলীর ঋজুতায় প্রকাশ করতে হয় বলে এই জাতীয় কবিতায় কবি হৃদয়ের স্বতস্ফূর্তির সুযোগ কম।
১০. এডমান্ড স্পেনসার তাঁর “অ্যামোরেটি” (১৫৯৫ খ্রিঃ) “Amorctti” কাব্যে শেক্সপীয়রীয় সনেটের গঠন রীতিতে নতুনত্ব এনে তাঁর প্রবর্তিত স্পেনসারের সনেট প্রবর্তন করেন।
তথ্যসূত্র
১. “সাহিত্যের রূপ-রীতি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ” – কুন্তল চট্টোপাধ্যায়।
২. “সাহিত্যের রূপরীতি কোষ” – ড. অশোককুমার মিশ্র।
৩. “সাহিত্য ও সমালোচনার রূপ-রীতি” – উজ্জ্বলকুমার মজুমদার।
৪. “বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত” (সপ্তম খণ্ড) – অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।
৫. “শ্রুতি সাহিত্য” – বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়
আলোচক – শুভাশিষ ঘোষ
Last edited on 04.07.2024 by Nilratan Chatterjee
আলোচনাটি খুব ভাল লেগেছে । সনেট নিয়ে এমন সাবলীল সিরিয়াস এবং কমপ্যাক্ট আলোচনা বিশেষ প্রশংসার দাবী রাখে ।
শৈবাল চট্টোপাধ্যায়
কথা: ৮৯১০০৭৯০৫৭
চমৎকার বিশ্লেষণ ! খুব ভাল লাগল। ধন্যবাদ।