রবীন্দ্রভাবনার আলোকে ‘ছিন্নপত্রাবলী’ – একটি মূল্যায়ণ
রবীন্দ্রনাথের প্রথম ও প্রধান পরিচয় তিনি কবি। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিভিন্ন শাখায় তাঁর সৃষ্টিশীল হাতের ছোঁয়া লাগলেও বিশ্বসাহিত্যে তাঁর খ্যাতির প্রধান বিষয় হল তাঁর কবি সত্তা। রবীন্দ্রসৃষ্টির সঙ্গে আমরা প্রত্যেকেই কমবেশি পরিচিত। কিন্তু এই সৃষ্টিসত্তার বাইরে ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ কেমন ছিলেন তা জানার কৌতূহল সবার। কবির জীবনীর মধ্যে চোখ রাখলেও কবির মানসপটের সব টুকুর পরিচয় পাওয়া সম্ভব নয়। তাঁর সৃষ্টিকর্মের মধ্যেই লুকিয়ে আছে তাঁর পরিচয়। কবিই বলেছেন –
[quote]”কবিরে পাবে না তাহার জীবন চরিতে”[/quote]
“আত্মপরিচয়” গ্রন্থে কবি বলেছেন “সফল কাব্যই কবির প্রকৃত জীবনী। সেই জীবনীর বিষয়ীভূত ব্যক্তিটিকে কাব্যরচয়িতার জীবনের সাধারণ ঘটনাগুলির মধ্যে ধরিবার চেষ্টা করা বিড়ম্বনা।” রবীন্দ্রনাথকে জানতে হলে, তাঁর মননের পরিচয় পেতে হলে তাঁর রচিত পত্রাবলির ভূমিকা অপরিসীম। রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই তাঁর লেখা পত্র, পত্রসাহিত্য রুপে প্রতীয়মান হয়ে উঠল,যার মধ্যে ফুটে উঠল রবীন্দ্রনাথের অন্তর আত্মার পরিচয়। রবীন্দ্রনাথের লেখা পত্রসাহিত্যের প্রাচুর্য ও বৈচিত্র্য আমাদের বিস্মৃত করে। রবীন্দ্র সাহিত্যের এক বিরাট জায়গা জুড়ে আছে এই পত্রসাহিত্য,যা কবির ভাবনার জগতের জীবন্ত দলিল হয়ে আছে।
রবীন্দ্রনাথের লেখা চিঠিপত্রের সংখ্যা প্রচুর। বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্র খন্ডিত আকারে প্রকাশ করেছে। কবির জীবনে প্রিয় মানুষদের উদ্দেশ্যে লেখা চিঠিতে কবির সৃষ্টির নানান দিক প্রকাশিত হয়েছে। মৃণালিনী দেবীকে লেখা চিঠি, রথীন্দ্রনাথ কে লেখা চিঠি, প্রতিমা দেবীকে লেখা চিঠি, ইন্দিরা দেবীকে লেখা চিঠি প্রভৃতি চিঠি স্থান পেয়েছে রবীন্দ্র পত্রসাহিত্য হিসাবে। এছাড়া মাধুরীলতা,মীরা, সত্যেন্দ্রনাথ, জ্ঞানদা দেবী, জগদীশ চন্দ্র বসু, কাদম্বিনী দেবী, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ প্রভৃতি কবির কাছের জন কে লেখা চিঠি চিঠিপত্রে স্থান পেয়েছে। শ্রীশচন্দ্র মজুমদার এবং ইন্দিরা দেবীকে লেখা চিঠি স্থান পেয়েছে – “ছিন্নপত্র” এ। নির্মল কুমারী মহলানবিশকে লেখা চিঠির সংকলন হল – “পথে ও পথের প্রান্তে”। রানু অধিকারী কে লিখিত চিঠি স্থান পেয়েছে – ভানুসিংহের পত্রবলীতে। ইন্দিরা দেবীকে লেখা পত্র স্থান পেয়েছে – “ছিন্নপত্রাবলী” তে।
রবীন্দ্র সৃষ্টির জগতে “ছিন্নপত্রাবলী” তে স্থান পাওয়া ইন্দিরা দেবীকে লেখা চিঠিতে কবি হৃদয়ের যে আর্তি ফুটে উঠেছে তা আমরা আলোচনা করে দেখব।”ছিন্নপত্রাবলী”তে কবিসত্তার বিকাশ কি ভাবে রুপ পেয়েছে তা আলোচনা করব।
শিলাইদহ, পাতিসর,সাজাদপুর প্রভৃতি স্থান রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির পথ কে মসৃণ করেছে। এই সব স্থানের নদীনালা,আকাশ মাঠ এবং অতিসাধারণ জনজীবন রবীন্দ্রসাহিত্যে বহু মূল্যবান সম্পদ সৃষ্টিতে সাহায্য করেছে। বিশ্বজগতের সঙ্গে কবির অন্তরঙ্গতার যথার্থ রুপ ফুটে উঠেছে তাঁর চিঠিতে। রবীন্দ্রনাথ যে চিঠি লিখতে পছন্দ করতেন তা অনেক সময় অনেক জায়গাতেই ব্যক্ত করেছেন। ইন্দিরা দেবীকে লেখা ছিন্নপত্রাবলীর ১৯৮ নং পত্রে তিনি বলেন -“…কথায় যে জিনিষটা এড়িয়ে যায় এবং প্রবন্ধে যে জিনিষ টা কৃত্রিম হয়ে ওঠে, চিঠিতে সেইটে অতি সহজে আপনাকে ধরা দেয়। ” তাঁর কবি জীবন ও ব্যক্তিজীবন পরস্পর বিচ্ছিন্ন নয়। ব্যক্তি জীবনের নানান ঘটনার পাশাপাশি যৌবনের প্রকৃতি দৃষ্টি ও মানবপ্রীতির এক সার্থক যুগলবন্দী এতে প্রতীয়মান হয়। রসস্রষ্টা ও রসভোক্তার মিলিত প্রয়াসেই আসে সৃষ্টির সার্থকতা। “ছিন্নপত্রাবলী” তে লেখা চিঠিতে প্রেরক রবীন্দ্রনাথ ও প্রাপক ইন্দিরা দেবীর মানস সংযোগ স্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ যেন নিজেকে অকপটে ও অনায়াসে নিজেকে প্রকাশ করেছেন। তাই “ছিন্নপত্রাবলী”র ১৬০ নং পত্রে কবি লিখেছেন –
[quote]”আমি জানি [বব] তোকে আমি যে-সব চিঠি লিখেছি তাতে আমার মনের সমস্ত বিচিত্রভাব যে রকম ব্যক্ত হয়েছে এমন আমার আর কোনো লেখায় হয় নি।”[/quote]
তাই বলা যায় ইন্দিরা দেবীকে লেখা চিঠিতেই শ্রষ্টা রবীন্দ্রনাথের প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায়। কবির লেখার জগতে বিশেষ করে কাব্য রচনায় এর ভূমিকা অপরিসীম। শিলাইদহে কবি বহুকাল কাটিয়েছেন। এই সময় মাঝে মাঝেই বন্ধু বান্ধব ও আত্মীয় স্বজনেরা এসেছেন, গুণীজন, সুহৃদ সকলকে নিয়েই রচিত হয়েছে তার পারিবারিক বৃত্ত। আর এই বৃত্তের বাইরে কবি খুঁজে পেয়েছিলেন এক সুবৃহৎ জগত পরিবার। শিলাইদহ পর্বই রবীন্দ্রসৃষ্টির চিত্রশালা ও কর্মশালা। এই যুগে রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্পের ও স্বর্ণযুগ হিসাবে অভিহিত করা হয়। এখান থেকেই উঠে এসেছে পল্লিজীবনের বহু ঘটনা,বহুছবি, বহু অভিজ্ঞতা, যা উপাদান রুপে ব্যবহৃত হয়েছে রবীন্দ্রসাহিত্যে। রবীন্দ্রনাথের স্বদেশী কর্মোদ্যোগ, পল্লীসংগঠনের প্রেরণা ও সূচনা এই শিলাইদহেই। বাল্যকাল থেকেই রবীন্দ্রনাথের কাছে কবিতা ছিল তাঁর প্রেয়সী।ছেলেবেলা থেকেই কবিতা ছিল তাঁর বাকদত্তা। পুকুরের ধার,বটের তলা, বাড়ির ভিতরের বাগান, একতলার অনাবিস্কৃত ঘর গুলি, সমস্ত বাইরের জগত, দাসীদের মুখে রুপকথা, ছড়া প্রভৃতি কবির মনে এক মায়ার জগত তৈরী করেছিল। এই প্রেয়সী সম্পর্কেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন – “ছিন্নপত্রাবলী”র ৯৪ নং পত্রে – ” যাকে বরণ করেন তাকে নিবিড় আনন্দ দেন , কিন্তু এক – এক সময় কঠিন আলিঙ্গনে হৃৎপিন্ডটি নিংড়ে রক্ত বের করে নেন। “
ছিন্নপত্রের কালপর্বেই রবীন্দ্রনাথের মনোজগতে এক ব্যকুল স্পন্দন অনুভূত হয়েছিল। প্রকৃতি ও মানব জীবন দুয়ে মিলে কবির ভাবনায় এক বিচিত্র কল্পনারঞ্জিত ভাবের প্রতিচ্ছবি লক্ষ্য করা যায় ছিন্নপত্রাবলীর পত্রপটে। জমিদারির কাজে শিলাইদহ – সাজাদপুর -পাতিসরে এসে কবিতা লিখে আনন্দ পেতেন। বৈশাখের খররৌদ্রতাপে কিংবা শ্রাবণের মুষলধার বর্ষণে কিংবা হেমন্তের পূর্ণিমায় কবির অন্তরলোক বিকশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের জীবনে ‘মৃত্যু’ এক বিশেষ ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়। কবির “মানসী” কাব্যে রচনা পর্বেই সূচনা ঘটে” ছিন্নপত্রাবলী” র।আর “মানসী” তেই প্রেম ও আঘাতের যুগপৎ পরিণতি দেখা যায় কবির মধ্যে। তবে যথার্থ ছিন্নপত্রের যুগের সূচনা ঘটে আরো একটু পরে। মূলত বিষাদের সুর দিয়েই “মানসী” র প্রথম পর্বের কবিতা গুলি লেখা। কবির এই বিষাদের ভাবনা পরবর্তীকালে লিখিত ছিন্নপত্রাবলীর কয়েকটি পত্রেও প্রকাশ পেয়েছে। “ছিন্নপত্রাবলীতে পাতিসর থেকে লেখা ১০ নং পত্রে তিনি বলেছেন – “… মা পৃথিবী লোকালয়ের মধ্যে আপন ছেলেপিলে এবং কোলাহল এবং ঘরকর্নার কাজ নিয়ে থাকে — যেখানে একটু ফাঁকা, একটু নিস্তব্ধতা, একটু খোলা আকাশ, সেইখানেই তার বিশাল হৃদয়ের অন্তর্নিহিত ঔদাস্য এবং বিষাদ ফুটে ওঠে ; সেইখানেই তার গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস শোনা যায়।… পৃথিবীর একটা অংশ আছে যেটা কর্মপটু, স্নেহশীল, সীমাবদ্ধ,তার ভাবটা আমাদের মনে তেমন প্রভাব বিস্তার করবার অবসর পায়নি। পৃথিবীর যে ভাবটা নির্জন, বিরল, অসীম, সেই আমাদের উদাসীন করে দিয়েছে। ” “ভৈরবীর গান” কবিতায় যে উদাসীনতা ও বিষাদ মগ্নতার ভাব আছে সেই ভাব লক্ষ্য করা যায় ছিন্নপত্রাবলী র এই চিঠিতেই। তাই তিনি লিখেছেন – “…সেতারে যখন ভৈরবীর মিড় টানে আমাদের ভারতবর্ষীয় হৃদয়ে একটা টান পড়ে। “
কবির ভাবনায় মাঝে মাঝেই অনুপ্রবেশ ঘটেছে বিশ্বচেতনার।”ছিন্নপত্রাবলী ” র ১৩ নং চিঠিতে সেই মর্ত্যপ্রীতি প্রকাশ পেয়েছে। তিনি বলেছেন -“আমাদের এই মাটির মা,আমাদের এই আপনাদের পৃথিবী,এর সোনার শস্যক্ষেত্রে,এর স্নেহশালিনী নদীগুলির ধারে, এর সুখদুঃখময় ভালোবাসার লোকালয়ের মধ্যে, এই সমস্ত দরিদ্র মর্ত্য হৃদয়ের অশ্রুর ধন গুলিকে কোলে করে এনে দিয়েছে।… আমি এই পৃথিবীকে ভারী ভালোবাসি। “
একদিকে রুপাতীত কাব্যাদর্শকল্পনা,অন্য দিকে এই রুপাদর্শ রুপায়ণের প্রয়াস, ছিন্নপত্রাবলী তে কবির এই দ্বৈতসত্তাকে “বাইরের আমি” এবং “অন্তঃপুরবাসী আত্মা” – এই দুই নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে।এই অন্তঃপুরবাসী আত্মাই কবির অন্তর্যামী। অন্তর্যামী বাইরের আমিকে যা বলাতে চান তাই প্রকাশ পায় কবির সৃষ্টির জগতে। কবির “অন্তর্যামী” নামক কবিতাতে সেই অন্তর জীবনের কথাই প্রকাশ পেয়েছে যা কবি তাঁর চিঠিতে স্বীকার করেছেন।
রবীন্দ্রনাথের জীবনে Real এবং Ideal এর দ্বন্দ্ব আজীবন বিরাজ করেছে। এই দুয়ের মিলন কোনো দিনই হয়ে ওঠেনি যার মিলন ঘটানই রবীন্দ্রনাথের কাছে আজীবন সাধনার বিষয় হয়ে উঠেছে। কবি নিজেও এই মিলন নিয়ে নিশ্চিত ছিলেন তাই ইন্দিরা দেবীকে লেখা ছিন্নপত্রাবলীর ১৮৩ নং পত্রে তিনি লিখেছেন -“…’ভবের সাথে ভাবের মিলন হবে কবে? ‘ — সম্পূর্ণ মিলন কোনোকালেই হবে না।কারণ, ভবও যতটা ভাবের কাছে অগ্রসর হতে থাকবে আবার ভাবও ততটা সম্মুখে অগ্রসর হয়ে চলবে। ঠিক যেন ভাবটা ভবের বড়ো ভাই,উভয়ের সমান বয়স হবার কোনো সম্ভাবনা নেই।” “ছিন্নপত্রাবলী” র এই অনুভব তাঁর অনান্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যেও দেখতে পাওয়া যায়।যা “সোনার তরী” এবং পরবর্তীতে “চিত্রা” তেও পরিস্ফুট।
“সোনার তরী” রবীন্দ্রনাথের পদ্মাবাসের কাব্য। পদ্মা প্রকৃতিকে আত্মস্থ করেই”সোনার তরী” পর্বে রবীন্দ্রনাথের কবিধর্ম পরিপূর্ণতা পেয়েছে। পদ্মার রহস্যময়তা ও অসীমতার আকর্ষণ স্বভাবতই কবিকে আকৃষ্ট করেছে। ১২৯৮ বঙ্গাব্দে লেখা “সোনার তরী” নাম কবিতাতেও পদ্মার অপার সৌন্দর্যের ছবিই যেন কবি বর্ণনা করেছেন। শিলাইদহ থেকে লেখা ছিন্নপত্রাবলীর ১০৩ নং চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ চোখের সামনে যা দেখেছেন তাই কাব্যে ফুটিয়ে তুলেছেন। চিঠিতে তিনি লিখেছেন -“আমাদের চরের মধ্যে নদীর জল প্রবেশ করেছে।চাষারা নৌকা বোঝাই করে কাঁচা ধান কেটে নিয়ে আসছে– আমার বোটের পাশ দিয়ে তাদের নৌকা যাচ্ছে আর ক্রমাগত হাহাকার শুনতে পাচ্ছি।যখন আর চারদিন থাকলে ধান পাকত, তখন কাঁচা ধান কেটে আনা চাষার পক্ষে যে কী নিদারুণ তা বেশ বুঝতেই পারছিস। ” রবীন্দ্রনাথের ভাবের জগতে ছিন্নপত্রাবলীর প্রভাব কতখানি তার আরো একটি পরিচয় পাওয়া যায়।সাজাদপুর থেকে লেখা একটি চিঠিতে রাত্রে স্বপ্ন দেখার কথা বলেছেন আর এই স্বপ্ন দেখা কে কেন্দ্র করে রচনা করেন “গানভঙ্গ” কবিতা। ভাবুক রবীন্দ্রনাথ তার মনের সমস্ত বিচিত্র ভাব ও গভীরতম সত্য কথা প্রকাশ করেছেন “ছিন্নপত্রাবলী” র কয়েকটি পত্রে।
রবীন্দ্রনাথের মর্ত্যপ্রীতির ও নিদর্শন ছড়িয়ে আছে ছিন্নপত্রাবলীর বিভিন্ন চিঠিতে। পল্লিবাংলার আকাশে বাতাসে জলে স্থলে এক রুপালোকের সন্ধান পেয়েছেন কবি। তাই তিনি লিখেছেন -” যদি বাসনা এবং সাধনা অনুরুপ পরকাল থাকে, তাহলে এবার আমি এই ওয়ারপড়ানো পৃথিবী থেকে বেরিয়ে গিয়ে যেন এক উদার উন্মুক্ত সৌন্দর্যের আনন্দলোকে গিয়ে জন্মগ্রহণ করতে পারি। “ছিন্নপত্রাবলী তে তত্ত্ব দর্শনের গভীর ঘন প্রভাব ও পরিলক্ষিত হয়।সমুদ্র সঙ্গে পৃথিবীর যোগসূত্র বা জন্মজন্মান্তরের মধ্যে প্রবাহিত প্রাণকে অনুভব করা এবং তাকে বিশ্লেষণ করা লক্ষ্য করা যায় “ছিন্নপত্রাবলী” তে। কবির লেখা “সমুদ্রের প্রতি” কবিতা রচনার পশ্চাদপটে কাজ করেছে কবির ব্যক্তিগত অনুভুতি। ছিন্নপত্রাবলীর ৯১ নং পত্রে কবি লিখেছেন -“এই পৃথিবীর সঙ্গে, সমুদ্রের সঙ্গে,আমাদের যে একটা বহুকালের গভীর আত্মীয়তা আছে, নির্জনে প্রকৃতির সঙ্গে মুখোমুখি করে অন্তরের মধ্যে অনুভব না করলে সে কি কিছুতেই বোঝানো যায়! ” “সোনার তরী” ভাবকল্পনা “চিত্রা”, “চৈতালী” তেও সমান ভাবে বিরাজমান। অনেক সমালোচক “চিত্রা” কেও “পদ্মার কাব্য” বলে অভিহিত করেন। এতেও যে ছবি ফুটে উঠেছে তা ছিন্নপত্রাবলীতেও সমানভাবে বর্ণিত। “চিত্রা” বহু কবিতাতে পদ্মার কথা আছে।শিলাইদহ, সাজাদপুর, পাতিসর পর্বে জমিদার রবীন্দ্রনাথের মনে সাধারণ প্রজাসাধারণের জন্য যে ব্যকুলতা চোখে পড়ে তা যে শুধুমাত্র কবির ভাবনার জগতেই সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়। সেখানকার মানুষজনের প্রতি নানান জনহিতকর কাজের মধ্য দিয়ে তিনি সেই মানুষগুলোর কাছে আসার চেষ্টা করেন, পল্লিসংগঠন তৈরী ছিল যার মধ্যে অন্যতম। মানুষের কষ্টকর জীবনিসংগ্রামের ছবি যে কবি মন কে ব্যথিত করত তা ছিন্নপত্রাবলী তে লেখা চিঠি থেকে আমরা জানতে পারি। ইন্দিরা দেবীকে লেখা ছিন্নপত্রাবলীর ১৫৩ নং চিঠি তিনি বলেছেন -” বড়ো বড়ো গাছ জলের মধ্যে তার সমস্ত গুঁড়িটি ডুবিয়ে দিয়ে শাখা প্রশাখা জলের উপর অবনত করে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে — আমগাছ বটগাছের অন্ধকার জঙ্গলের ভিতরে নৌকা বাঁধা এবং তারই মধ্যে প্রচ্ছন্ন হয়ে গ্রামের লোকেরা স্নান করছে।এক- একটি কুড়েঁ ঘর স্রোতের মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার চারি পার্শ্বের সমস্ত প্রাঙ্গণ জলমগ্ন।… এ অঞ্চলের বর্ষার গ্রামগুলি এমন অস্বাস্থ্যকর আরামহীন আকার ধারণ করে যে তার পাশ দিয়ে যেতে গা কেমন করে।… এত অবহেলা অস্বাস্থ্য অসৌন্দর্য দারিদ্র বর্বরতা মানুষের আবাসস্থলে কিছুতেই শোভা পায় না। “
রোমান্টিক কল্পলোক থেকে বাস্তবের কর্মলোকে কবির প্রত্যাবর্তন” চিত্রা” র ‘ এবার ফিরাও মোরে’, ‘ স্বর্গ হইতে বিদায়’ প্রভৃতি কবিতার প্রেক্ষাপট নির্মানে সহায়তা করেছে। প্রকৃতি প্রীতির প্রাবল্যে মানবপ্রীতি উপেক্ষিত হয়নি ছিন্নপত্রাবলীর জগতে। প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। মানুষ প্রকৃতির পরিপূরক তাই নিসর্গ সৌন্দর্যকে মানুষের জীবনাচরনের মধ্যে ধরতে চেয়েছেন কবি। সজন- নির্জনের সান্নিধ্য রবীন্দ্রনাথের মন রুপকথার জগতেও অভিসার করেছে। রুপকথার জগত কেবল কল্পনার জগত।”মানসী” পর্বে যে “অসীমের সীমা “র প্রবর্তনা এসেছিল “সোনার তরী” তে এসে রুপময় অরুপকে ধরার বাসনা রুপ নিল রুপকথার মধ্য দিয়ে। সেই রুপকথার হাতছানির কথা ইন্দিরা দেবীকে লেখা ছিন্নপত্রাবলীর অনেক চিঠির মধ্যেই তা লক্ষ্য করা যায়।ছিন্নপত্রাবলীর ১৯ নং,৩৫ নং চিঠিতে তার উল্ল্যেখ পাওয়া যায়। “ছিন্নপত্রাবলী” কবির অনেক কবিতা, গান,ছোটোগল্প ইত্যাদি নানা সৃষ্টির উৎসভূমি।
রবীন্দ্র পত্রসাহিত্যের ইতিহাসে ছিন্নপত্র/ ছিন্নপত্রাবলীতেই সর্বপ্রথম স্মৃতিচারী এক মুগ্ধ মনের পরিচয় পাই। বিশ্ব প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম সান্নিধ্যে থেকে কবি বলেছেন ” এখানকার প্রকৃতির সঙ্গে সেই আমার একটি মানসিক ঘরকন্নার সম্পর্ক।”কবিমানস ও নিসর্গের মিলন থেকে জন্ম নিয়েছে এই পত্রগুলি। ইন্দিরা দেবীকে লেখা চিঠিতে কবি বলেছেন ” আমার অনেক সময় ইচ্ছা করে, তোকে যে সমস্ত চিঠি লিখেছি, সেগুলি নিয়ে পড়তে পড়তে আমার অনেক দিনকার সঞ্চিত অনেক সকাল দুপুর সন্ধ্যার ভিতর দিয়ে আমার চিঠির সরু রাস্তা বেয়ে আমার পুরানো পরিচিত দৃশ্যগুলির মাঝখান দিয়ে চলে যাই। “পত্রগুলি কবির কাছে স্মৃতি হয়েই ধরা দিয়েছে।
“ছিন্নপত্রাবলী”র পত্রগুলি যেন এক একটা উজ্জ্বল নিদর্শন। যার কোনোটিতে কবির বিষাদের স্পর্শ, কোনোটিতে আছে আনন্দের মূর্চ্ছনা,কোথায় আছে নিসর্গ প্রকৃতির সৌন্দর্য, কোথায় গ্রাম বাংলার রুগ্নতা। সর্বোপরি বলা যায়, কবি রবীন্দ্রনাথের পরিপূর্ণ ভাবে জানতে গেলে ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথকে জানতে হবে। যার অন্যতম অবলম্বন তাঁর পত্র। যা পত্রসাহিত্য রুপে সমগ্র বাংলা সাহিত্যে এক বিশেষ জায়গা দখল করে আছে।
আলোচক – সুকান্ত চ্যাট্টার্জী, বাংলা সাহিত্যের ছাত্র, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়।
Thank you সুকান্তদা
আজকের দিনে এটা পেয়ে অনেক উপকৃত হলাম ।।