
মেঘনাদবধ কাব্য ও বীরাঙ্গনা কাব্য
বাংলা কাব্যসাহিত্যের স্মরণীয় দুটি কাব্য মেঘনাদবধ কাব্য ও বীরাঙ্গনা কাব্য। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের এই দুই কাব্য সম্পর্কে যথাসম্ভব খুঁটিনাটি তথ্য পাবেন পাঠক পাঠিকা।
মেঘনাদবধ কাব্য
বাংলা কাব্যসাহিত্যের স্মরণীয় একটি কাব্য। নয়টি সর্গে রচিত এই কাব্যটি রামায়ণের বীরবাহু নিধন থেকে প্রমীলার চিতারোহণ পর্যন্ত ঘটনাকে অবলম্বন করে রচিত। কাব্যটি বীর ও করুণ রসাশ্রিত একটি মহাকাব্য। কেন্দ্রীয় চরিত্র মেঘনাদ বা ইন্দ্রজিৎ। সমগ্র কাব্যে তিন দিন দুই রাত্রির কাহিনি পরিবেশিত হয়েছে।
প্রথম সর্গ
মেঘনাদবধ কাব্যের প্রথম সর্গের নাম ‘অভিষেক’। এই সর্গে বীরবাহুর নিধন সংবাদ নিয়ে রাজসভায় দূতের আগমন, রাবণের বিলাপ, পুত্রশোকাতুরা চিত্রাঙ্গদার রাবণকে ভর্ৎসনা, রাবণের যুদ্ধযাত্রার প্রস্তুতি, ধাত্রীর বেশে লক্ষ্মীদেবীর মেঘনাদকে বীরবাহু-নিধন সংবাদ দেওয়া ও রাবণের যুদ্ধ প্রস্তুতির খবর জানানো, মেঘনাদ ইন্দ্রজিতের ক্ষোভ এবং রাবণের কাছে গিয়ে যুদ্ধযাত্রার অনুমতি প্রার্থনা, অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেঘনাদকে রাবণের সেনাপতি পদে অভিষিক্ত করা –এর মধ্য দিয়েই সমাপ্ত হয়েছে এই সর্গটি।
দ্বিতীয় সর্গ
দ্বিতীয় সর্গের নাম ‘অস্ত্রলাভ’। এই সর্গের সূচনা সন্ধ্যাকালে। ইন্দ্রের সভায় হাজির হয়ে লক্ষ্মীদেবীর রাম-রাবণের যুদ্ধের বার্তা প্রদান, রামচন্দ্রকে রক্ষা করার উপায় সন্ধান, মহাদেবের নিকট ইন্দ্রের সহায়তা প্রার্থনা এবং মহাদেবের নির্দেশে ইন্দ্র ও মায়ার সাক্ষাৎ, রামচন্দ্রকে ইন্দ্র প্রদত্ত অস্ত্র দান –এই সমস্ত ঘটনার মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় সর্গের সমাপ্তি।
তৃতীয় সর্গ
ঐ একই রাত্রিতে আরম্ভ হয়েছে তৃতীয় সর্গ ‘সমাগম’। এই সর্গে প্রমীলা ও ইন্দ্রজিতের মিলন দেখানো হয়েছে। বলা যায় এই সর্গের রচনায় কবির রোম্যান্টিক কল্পনা এবং ইন্দ্রজিত ও প্রমীলার দাম্পত্য-প্রেম সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে।
চতুর্থ সর্গ
কাব্যের চতুর্থ সর্গের নাম ‘অশোকবন’। ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় কাব্যের এই সর্গ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘যেন কল্লোলিত সমুদ্রের মধ্যে একটি শ্যামস্নিগ্ধ দ্বীপ।’ এই সর্গে কবি অঙ্কিত সীতা চরিত্রটি মৌলিক ও হৃদয়স্পর্শী হতে পেরেছে। বাঙালি সংস্কার মেনে কবি যেন অঙ্কন করেছেন সীতা চরিত্রটিকে। অশোকবনে সীতা ও সরমার সংলাপই এই সর্গের মুখ্য বিষয়।
পঞ্চম সর্গ
পঞ্চম সর্গে ইন্দ্রজিৎ মেঘনাদকে হত্যার আয়োজন করা হয়েছে। সর্গটির নাম ‘উদ্যোগ পর্ব’। একদিকে মেঘনাদকে হত্যার জন্য লক্ষ্মণের দেবী মহামায়ার অনুগ্রহ লাভ অন্যদিকে সুখাসীন মেঘনাদ ও প্রমীলা। পাশাপাশি এই দুই চিত্র অঙ্কিত হয়েছে সর্গটিতে।
ষষ্ঠ সর্গ
ষষ্ঠ সর্গের নাম ‘বধ’। কবি এই সর্গে মেঘনাদ ও লক্ষ্মণ –এই দুই বীরকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন। কিন্তু তুলনামূলকভাবে লক্ষ্মণ চরিত্রের বীরত্ব অনুজ্জ্বল হয়ে পড়েছে। দেববলে বলী লক্ষ্মণ বীর মেঘনাদকে হত্যা করার জন্য কৌশল অবলম্বন করেছেন এবং নিকুম্ভিলা যজ্ঞগৃহে যজ্ঞরত মেঘনাদকে হত্যা করেছেন।
সপ্তম সর্গ
সপ্তম সর্গের নাম ‘শক্তিনির্ভেদ’। বীর মেঘনাদের হত্যার পর পুত্রহারা রাবণের যুদ্ধযাত্রা এবং লক্ষ্মণকে শক্তিশেল দ্বারা আঘাত করা এই সর্গের মূল বর্ণিতব্য বিষয়।
অষ্টম সর্গ
অষ্টম সর্গ ‘প্রেতপুরী’তে শক্তিশেলাঘাতে মূর্চ্ছিত লক্ষ্মণ কীভাবে জীবন ফিরে পেতে পারেন সে জন্য রামচন্দ্রের প্রেতপুরী যাত্রা এবং দশরথের প্রেতাত্মার সাক্ষাৎ গ্রহণ দেখানো হয়েছে।
নবম সর্গ
কাব্যের শেষ সর্গের নাম সংস্ক্রিয়া। এই সর্গে মেঘনাদের শবযাত্রা, পিতা রাবণের বিলাপ ও হাহাকার, দেশময় শোক পালন, স্বামীর চিতায় প্রমীলার আরোহণ, এককথায় লঙ্কা ও রাবণের শোকাবহ পরিণাম এই সর্গের মুখ্য বিষয়।
প্রকাশ ও সংস্করণ
কাব্যটি প্রথমে দুটি খণ্ডে প্রকাশিত হয়। পাঁচটি সর্গ নিয়ে প্রথম খণ্ডটি প্রকাশিত হয় ১৮৬১ (১২৬৭ বঙ্গাব্দে) খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে। ঐ বছরের মাঝামাঝি প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় খণ্ড, ষষ্ঠ থেকে নবম সর্গ। হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় কাব্যটির দ্বিতীয় সংস্করণ দুটি খণ্ডে প্রকাশিত হয় ১২৬৯ ও ১২৭০ বঙ্গাব্দে। কাব্যের চতুর্থ সংস্করণে ‘ভূমিকা’ যুক্ত করা হয়। স্মরণীয় যে, মধুসূদনের জীবদ্দশায় এই কাব্যটির ছয়টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এই ষষ্ঠ সংস্করণ থেকেই দুই খণ্ড একত্রে সম্পূর্ণ ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ প্রকাশিত হয় ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের ২০ শে জুলাই। কাব্যটি রাজা দিগম্বর মিত্রকে উৎসর্গ করা হয়েছে।
বীরাঙ্গনা কাব্য
মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা সাহিত্যে প্রথম মহাকাব্য লিখেছেন। তিনিই প্রথম সার্থক নাটকের স্রষ্টা। বাংলা সাহিত্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের ব্যবহার করে তিনিই বাংলা সাহিত্যকে পরিণতির পথ দেখিয়েছেন। তিনি যেমন বাংলায় প্রথম সনেট লিখেছেন, প্রথম প্রহসন লিখেছেন এমনকি প্রথম গীতিকবিতার জন্মও তাঁর হাত ধরে তেমনি প্রথম পত্রকাব্যের স্রষ্টাও মধু-কবি।
‘বীরাঙ্গনা’ (১৮৬২) মধুসূদন দত্ত লিখিত বাংলা সাহিত্যের প্রথম পত্রকাব্য। কাব্যটিতে মোট এগারোটি পত্র আছে যদিও কবির পরিকল্পনা ছিল একুশটি পত্রের। কাব্যে ওভিদের ‘The Heroides or Epistle of the Heroines’ এর আদর্শ অনুসৃত হয়েছে। কাব্যের সর্গ সংখ্যা এগারোটি।
এক একটি সর্গে এক একটি পত্র আছে। পত্রগুলি হল যথাক্রমে – দুষ্মন্তের প্রতি শকুন্তলা, সোমের প্রতি তারা, দ্বারকানাথের প্রতি রুক্মিণী, দশরথের প্রতি কৈকেয়ী, লক্ষ্মণের প্রতি শূর্পনখা, অর্জুনের প্রতি দ্রৌপদী, দুর্যোধনের প্রতি ভানুমতী, জয়দ্রথের প্রতি দুঃশলা, শান্তনুর প্রতি জাহ্নবী, পুরুরবার প্রতি উর্বশী এবং নীলধ্বজের প্রতি জনা। এই সকল পত্রের কোনোটিতে আছে প্রেমাষ্পদের প্রেম প্রার্থনা ও মিলনের আকাঙ্ক্ষা, কোনোটিতে ইন্দ্রিয় সম্পর্কযুক্ত প্রেমের মোহ ছিন্নের নির্দেশ, আবার কোথাও ধরা পড়েছে স্বামীর অনুচিত কর্মে অনুযোগ।
কবি এই কাব্যে পত্রাকারে নায়িকার চিত্ত উদ্ঘাটন করেছেন, তুলে ধরেছেন নারীজীবনের নানা অবস্থা ও সমস্যাকে। ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যে যেমন আছে মেঘনাদবধ কাব্যের গাম্ভীর্য তেমনি আছে ব্রজাঙ্গনার মাধুর্য। কাব্যের ভাষায় আছে গীতিধর্মিতা। বঙ্কিমচন্দ্রের মতে, ‘ভাষার লালিত্যে ও ছন্দের পারিপাট্যে মধুকবির বীরাঙ্গনা সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা।’ মধুসূদনের জীবদ্দশায় এই কাব্যের তিনটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। কাব্যটি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে উৎসর্গ করা হয়েছে।

