উপন্যাস ও ছোটগল্পবাংলা সাহিত্য

আশাপূর্ণা দেবী – জীবন ও সাহিত্য

আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের ধারায় উল্লেখযোগ্য নাম আশাপূর্ণা দেবী । আমাদের এই আলোচনায় লেখিকার পরিচয় ও সাহিত্যসেবার নানা তথ্য তুলে ধরার প্রয়াস করা হয়েছে। তথ্যগুলি আগ্রহী পাঠক পাঠিকার চাহিদা মেটাবে এমনটি আশা রাখি।

জন্ম পরিচয়

১৩১৫ বঙ্গাব্দের ২৪ শে পৌষ (ইং – ১৯০৯ খ্রীস্টাব্দের ৮ ই জানুয়ারী) – এ কলকাতার পটলডাঙ্গায় মামার বাড়িতে আশাপূর্ণা দেবী জন্মগ্রহণ করেন। আদি নিবাস ছিল হুগলীর বেগমপুর। সেখান থেকে পরে উওর কলকাতার বৃন্দাবন বসু লেনে গুপ্ত পরিবারে বসবাস শুরু করেন । পিতা – হরেন্দ্রনাথ গুপ্ত ছিলেন কলকাতার এক বিখ্যাত চিত্রশিল্পী এবং মাতা – সরলামুখী দেবী ছিলেন অত্যন্ত বিদূষী মহিলা , সাহিত্যপাঠে তীব্র আকর্ষণ ছিল । বাড়ির কত্রী ছিলেন নিস্তারিনী দেবী অর্থাৎ আশাপূর্ণার ঠাকুমা । উনার কঠোর নির্দেশেই গুপ্ত পরিবারের মেয়েদের বিদ্যালয় নির্ভর শিক্ষার পথ বন্ধ হয়ে যায় । তাই সাড়ে পাঁচ বছর বয়সেও আশাপূর্ণা দেবীকে কোনো বিদ্যালয়ের দরজা চেনানো হয়নি ।

পারিবারিক পরিচয়

১৯২৪ সালের আগস্ট মাসে মাত্র ১৫ বছর ৮ মাস বয়সে তিনি কৃষ্ণনগর নিবাসী কালিদাস গুপ্তের সহিত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন । ১৯২৬ – ১৯২৯ সালের মধ্যে একমাত্র কন্যা পুষ্পরেণু ও দুই পুত্র সন্তান – প্রশান্ত ও সুশান্তের জন্ম দেন । ১৯৩০ – ১৯৩১ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে নিজে এবং স্বামী মিলে পূর্ণানন্দের কাছে দীক্ষা নেন । এইভাবে তাঁর লেখিকা জীবনের সঙ্গে পরিবার জীবন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত । এতোসবের মধ্যে দিয়েও তিনি পরিবারের প্রতি কর্তব্যটুকু সামলে রেখেছেন । একজন সুগৃহিণীর পক্ষ্যে সুলেখিকা হওয়া যে অসম্ভব নয় , তিনি তা প্রমাণ করে ছেড়েছেন ।

সাহিত্যচর্চা

আশাপূর্ণা দেবীর সাহিত্যচর্চার সূত্রপাত ঘটে ১৯২২ খ্রীস্টাব্দ থেকে । মাত্র সাড়ে তেরো কিংবা চদ্দো বছর বয়সে তিনি ‘শিশুসাথী’ পত্রিকায় গোপনে “বাইরের ডাক” নামে একটি কবিতা পাঠান , তা প্রকাশিত হবার পরই লেখিকা প্রতিভার বিচ্ছুরণ হয় । প্রথম গল্প লেখেন “পাশাপাশি” । এরপর থেকে আর তিনি পিছন ফিরে তাকানোর সময় সময় পাননি। শেষপর্যন্ত তিনি গল্পকাহিনী রচনাতেই মনোনিবেশ করে বসেন। গল্প ছাড়াও তিনি লিখতেন উপন্যাস, যা থেকে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে ১৭৬ টি উপন্যাস, ৩০ টি ছোটোগল্প সংকলন, ৪৭ টি ছোটোদের বই, আন্যান্য সংকলন ২৫ টি এবং বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় অনূদিত গ্রন্থ ৬৩ টি ।

এছাড়াও তিনি লিখেছেন কবিতা – রম্যরচনা – স্মৃতিকথামূলক রচনা সাহিত্য , সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক প্রবন্ধ । এইভাবে তিনি তাঁর বিভিন্ন রচনার মধ্যে নারী সমাজকে তো জাগ্রত করেছেনই , সঙ্গে সঙ্গে বাল্য থেকে শুরু করে বার্ধক্য বয়সের মানুষকেও উদবুদ্ধ করে তুলেছিলেন । তেরো – চোদ্দ বছর বয়স থেকে লেখালেখি করলেও তাঁর আটত্রিশ বছর বয়সে তিনি এক পুরস্কার বিতরনী সভায় যোগ দিয়ে সেখান থেকেই গৃহ ছেড়ে বাইরের জগতে আসেন । এরপর বিভিন্ন সাহিত্যিকদের অর্থাৎ তারাশঙ্কর , সুনীতিকুমার , বিভূতিভূষণ প্রমূখের সহিত পরিচিত হোন ।

রচনাবলী

আশাপূর্ণা দেবীর উপন্যাসগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল –
প্রেম ও প্রয়োজন (১৯৪৪) অনির্বাণ (১৯৪৫) মিত্তির বাড়ি (১৯৪৭) অগ্নিপরীক্ষা (১৯৫২) যোগবিয়োগ (১৯৫৩) নবজন্ম (১৯৫৪) কল্যাণী (১৯৫৪) নির্জন পৃথিবী (১৯৫৫) ছাড়পত্র (১৯৫৯) সমুদ্র নীল আকাশ নীল (১৯৬১) দিগন্তের রঙ (১৯৬২) নদী দিক হারা (১৯৬২) প্রভৃতি ।

আশাপূর্ণা দেবীর গল্পসংকলন / সংকলন গ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল —
জল আর আগুন (১৯৩৮, মতান্তরে ১৯৪৪) ছোটো ঠাকুরদার কাশীযাত্রা (১৯৩৮) হাফ হলিডে (১৯৪১) রঙিন মলাট (১৯৪১) শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৫৪) অবচেতন (১৯৬০) হাসির গল্প (১৯৬৭) মানুষের মত মানুষ (১৯৮৬) কড়া পাকের পাকচক্র (১৯৯৭) প্ল্যানচেট (১৯৯৯) -প্রভৃতি ।

আশাপূর্ণা দেবীর স্মৃতিকথনমূলক রচনাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল –
আমার ছেলেবেলা (১৩৯২) আমার সাহিত্য চিন্তা (১৩৮৫) নেশা নয় , পেশা নয় , লেখাই যাঁর জীবন (১৩৯৭) ক্ষতির হিসাব (১৯৯২) – প্রভৃতি ।

পুরস্কার

১৯৬৬ – রবীন্দ্র পুরস্কার (“প্রথম প্রতিশ্রুতি” উপন্যাসের জন্য)
১৯৭৬ – জ্ঞানপীঠ পুরস্কার
১৯৭৬ – ভুবনেশ্বরী পদক
১৯৮৯ – শরৎস্মৃতি পুরস্কার
১৯৯৩ – জগত্তারিণী স্বর্ণপদক
১৯৯৪ – সাহিত্য আকাদেমী

সম্মান

১৯৭৬ – পদ্মশ্রী
১৯৮৩ – সাম্মানিক ডক্টরেট (জব্বলপুর বিশ্ববিদ্যালয়)
১৯৮৭ – সাম্মানিক ডক্টরেট ( রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়)

মূল্যায়ণ

এইভাবে গল্প – উপন্যাসে মধ্য দিয়ে বাংলা কথ্যসাহিত্যকে এক উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত করে দিয়ে আশাপূর্ণা দেবী যে বিপুল সাহিত্য সৃষ্টি করে গেছেন এককথায় তাকে আমরা অনস্বীকার্য ছাড়া আর কিছুই বলতে পারি না ।