রূপতত্ত্ব

লিঙ্গ বচন ও পুরুষ

বাংলা ব্যাকরণের একটি বিশেষ অংশ লিঙ্গ বচন ও পুরুষ। আমরা ক্রমাণ্বয়ে লিঙ্গ বচন ও পুরুষ সম্পর্কিত সহজ আলোচনা করব। সেইসঙ্গে লিঙ্গ পরিবর্তন বা লিঙ্গান্তরের বহু উদাহরণ তুলে ধরব। পাঠক পাঠিকা এই পোস্ট থেকে বিশেষ সহায়তা পাবেন তা আশা করি।

লিঙ্গ বচন ও পুরুষ

লিঙ্গ বচন ও পুরুষের আলোচনায় আমাদের প্রথম আলোচ্য লিঙ্গ ও লিঙ্গ পরিবর্তন। সহজ উদাহরণের মাধ্যমে আমরা বিষয়টি বুঝে নেব।

লিঙ্গ কাকে বলে ?

‘মেলায় ভাই আর বোনে একটি করে খেলনা কিনেছে।’

উপরের এই বাক্যটিতে ব্যবহৃত ‘ভাই’ পদের মধ্য দিয়ে আমরা বুঝে থাকি কোনো পুরুষ চরিত্রকে। একই ভাবে ‘বোন’ পদে বুঝি কোনো স্ত্রী চরিত্রকে। কিন্তু ‘খেলনা’ পদে পুরুষ বা স্ত্রী বিশেষভাবে বোঝায় না। বাক্যে ব্যবহৃত এই পদগুলির কোনোটি পুরুষ জাতীয় জীবকে, কোনোটি স্ত্রী জাতীয় জীবকে আবার কোনোটি অপ্রাণিবাচক একটি বস্তুকে নির্দেশ করে। এই যে ভিন্ন ভিন্ন পদের দ্বারা কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে একেই লিঙ্গ বলা হয়।

অতএব, ব্যাকরণের আলোচনায় ‘লিঙ্গ’ শব্দটির অর্থ হল ‘লক্ষণ’ বা ‘চিহ্ন’।

লিঙ্গের শ্রেণি

বাংলা ব্যাকরণে লিঙ্গ তিন প্রকার – পুংলিঙ্গ, স্ত্রীলিঙ্গ ও ক্লীবলিঙ্গ।

যে সকল চিহ্ন দ্বারা পুরুষ জাতীয় জীব বোঝানো হয় তাদের পুংলিঙ্গ বলে। যেমন – পিতা, পুত্র, শিক্ষক, রাজা, বাদশাহ, নিন্দুক, নাপিত ইত্যাদি।

আর যে সকল চিহ্ন দ্বারা স্ত্রী জাতীয় জীব বোঝানো হয় তাদের স্ত্রীলিঙ্গ বলে। যেমন – মাতা, কন্যা, শিক্ষিকা, রানী, নিন্দুকী, অভাগী, চাকরানী ইত্যাদি।

অনেক সময় কোনো কোনো শব্দে বিশেষভাবে স্ত্রী বা পুরুষ না বুঝিয়ে উভয়কেই বোঝায়, তখন তা উভলিঙ্গ হয়। যেমন – শিশু, চালাক, মেজাজী, রাগী, মালিক, রাঁধুনি ইত্যাদি।

অন্যদিকে যে সকল চিহ্ন দ্বারা পুরুষ বা স্ত্রী কোনোটিই বোঝায় না, অপ্রাণিবাচক কোনো বস্তুকে বোঝায় তাকেই ক্লীবলিঙ্গ বলে। যেমন – কলম, বই, গাড়ি, কান্না, গাছ, ফুল, ফল ইত্যাদি।

প্রসঙ্গত মনে রাখতে হবে কেবল প্রাণিবাচক শব্দের ক্ষেত্রে পুংলিঙ্গ অথবা স্ত্রীলিঙ্গ হয়, কিন্তু ক্লীবলিঙ্গ হয় অপ্রাণিবাচক শব্দে।

লিঙ্গ পরিবর্তন বা লিঙ্গান্তর

কোকিলকোকিলা
নবীননবীনা
সেবকসেবিকা
কৃতবিদ্যকৃতবিদ্যা
মক্ষিকমক্ষিকা
মনোহরমনোহরা
বাহকবাহিকা
রঞ্জকরঞ্জিকা
প্রচারকপ্রচারিকা
কারককারিকা
পাচকপাচিকা
বাহকবাহিকা
নায়কনায়িকা
সকর্মকসকর্মিকা
বৃহৎবৃহতী
শ্রীমানশ্রীমতী
রচয়িতারচয়িত্রী
ভর্তাভর্ত্রী
মৃন্ময়মৃন্ময়ী
সদৃশসদৃশী
স্রষ্টাস্রষ্ট্রী
বলীয়ানবলীয়সী
চকোরচকোরী
গৃহীগৃহিনী
বিলাসীবিলাসিনী
মায়াবীমায়াবিনী
সম্রাটসম্রাজ্ঞী
বিদ্বানবিদূষী
মদ্দামাদী
এঁড়েবকনা
খানসামাআয়া
নবাববেগম
কবিমহিলাকবি 
সভামহিলাসভা
সিংহসিংহী
মুচিমুচিবৌ
হিংসুটেহিংসুটী
অভাগাঅভাগী
পোঁটলাপুঁটলি
গয়লাগয়লানী
তেলিতেলিনী
চৌধুরীচৌধুরানী
গ্রাহকগ্রাহিকা
নর্তকনর্তকী
নিশাচরনিশাচরী
বৎসবৎসা
মহিমময়মহিমময়ী
আত্রেয়আত্রেয়ী
প্রাকপ্রাচী
অষ্টাদশঅষ্টাদশী
পলাতকপলাতকা
মহোদয়মহোদয়া
সম্পাদকসম্পাদিকা
সাপ্তাহিকসাপ্তাহিকী
শাশ্বতশাশ্বতী
বিহঙ্গবিহঙ্গী
গার্গ্যগার্গী
ষোড়শষোড়শী
কর্তাকর্ত্রী / গিন্নি
তুরঙ্গতুরঙ্গী
ধাতাধাত্রী
শ্রোতাশ্রোত্রী
তেজস্বীতেজস্বিনী
বরুণবরুণানী
ভবভবানী
রুদ্ররুদ্রানী
শিবশিবানী
উপাধ্যায়উপাধ্যায়ী
শুদ্রশুদ্রানী
বৈশ্যবৈশ্যা
শুকশারী
সখাসখী
ধবলধবলী
রাজারানী/রাজ্ঞী 
রজকরজকিনী
জনকজননী
নিন্দুকনিন্দুকী
রাজপুতরাজপুতানী
চাকরচাকরানী
চোরচোরনী
মালীমালিনী
ডোমডোমনী
ডাকডাকিনী
দুখিদুখিনী
ক্ষত্রিয়ক্ষত্রিয়ী
খ্যাতনামাখ্যাতনাম্নী
তনুতন্বী
বিদেশিবিদেশিনী
স্রোতস্বীস্রোতস্বিনী
গুণবানগুণবতী
মার্জারমার্জারী
গণকগণকী
প্রাপকপ্রাপিকা
শিষ্যশিষ্যা
ত্রয়ত্রয়ী
ঠাকুরঠাকুরানী
চামারচামারনী
ধেড়েধাড়ী
বাড়িওয়ালাবাড়িওয়ালি
চাচাচাচী
অনাথঅনাথিনী
নন্দাইননদ

বচন

‘এনেছি যে মালাখানি তোমাদের তরে।’

উপরের বাক্যটিতে ব্যবহৃত ‘মালাখানি’ পদে একটি মালার কথা বোঝা যায়। অর্থাৎ আমরা মালার সংখ্যা সম্পর্কে অবহিত হতে পারি। আবার ‘তোমাদের’ পদে সংখ্যাটি একাধিক বোঝায়। এই যে সংখ্যার তারতম্য তা নির্ধারণ করছে বচন। তাহলে বচন কোনো পদার্থের অর্থাৎ ব্যক্তি, বস্তু, গুণ ইত্যাদির সংখ্যা সম্পর্কে আমাদের বোধ জন্মাতে সহায়তা করে।

প্রসঙ্গত জেনে রাখা ভালো, বচন নির্ণয়ে ব্যবহৃত কিছু নির্দেশক হল – টা, টি, টুকু, খানি, খানা, গাছি, গাছা, গুলি, গুলা, গুলো ইত্যাদি। বাংলা ব্যাকরণের আলোচনায় বচন দুই প্রকার – একবচন ও বহুবচন।

যার দ্বারা কেবল একটি পদার্থ বা একটি ব্যক্তিকে বোঝা যায় তাকে একবচন বলে। একবচনের কয়েকটি উদাহরণ হল – মেয়েটি, পাখি, মালাখানি, বই, কলম ইত্যাদি।

অপরদিকে যার দ্বারা একাধিক পদার্থ বা ব্যক্তিকে বোঝায় তাকে বহুবচন বলে। বহুবচনের কয়েকটি উদাহরণ হল – মেয়েরা, পাখিগুলি, মালাগুলো, বইগুলি, তোমরা ইত্যাদি।

তবে অনেক সময় একবচনের ব্যবহারে বহুবচনের প্রকাশ ঘটে যেমন – ‘নির্মল বাবু টিউশনিতে ছেলে পড়াচ্ছেন।’ এই উদাহরণে ‘ছেলে’ একবচন হলেও বহুবচনের ভাবটিই প্রকাশ পাচ্ছে। নির্মল বাবু টিউশনিতে একটি নয়, অনেক ছেলে পড়াচ্ছেন – এই ভাবটিই প্রকট।

আবার উল্টোদিকে বহুবচনের রূপ দিয়ে একবচনের প্রকাশ ঘটে এমনও দেখা যায়। যেমন – ‘আমরা এর প্রতিবাদে কবিতা লিখেছি।’ – এই উদাহরণে ‘আমরা’ বহুবচন হলেও প্রকৃতপক্ষে তা একবচনের ভাবটি প্রকাশ করছে। কবিতা লেখার কাজটি একজনই করেছেন।

পুরুষ

‘আমি তোমাকে বলেছিলাম যে তিনি আসতে পারবেন না।’

খুব সহজভাবে বললে এই বাক্যে তিনটি ব্যক্তি রয়েছেন – বাক্যের বক্তা (আমি), বাক্যের শ্রোতা (তোমাকে) এবং উদ্দিষ্ট বা অনুপস্থিত একজন (তিনি)। এই ‘আমি’, ‘তোমাকে’ এবং ‘তিনি’ ব্যাকরণের ভাষায় ক্রিয়ার আশ্রয়। এগুলি ব্যবহৃত হয়েছে নামের পরিবর্তে। ব্যাকরণের ভাষায় এরই নাম পুরুষ।

বস্তুত, ব্যাকরণের আলোচনায় ‘পুরুষ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয় পারিভাষিক অর্থে, কোনো জাতিবিশেষ নয়। বাংলা ব্যাকরণে পুরুষের সংখ্যা তিনটি – উত্তম পুরুষ, মধ্যম পুরুষ ও প্রথম পুরুষ।

বাক্যের বক্তা যখন নিজের নামের পরিবর্তে কোনো সর্বনামের প্রয়োগ করেন তখন তা উত্তম পুরুষ হয়। যেমন – আমি, আমরা, মম, মোদের, মুই, আমারে, আমাকে, মোরা ইত্যাদি।

বক্তা যখন তার সামনে থাকা কারও উদ্দেশ্যে কিছু বলার সময় যে সমস্ত সর্বনামের প্রয়োগ করেন তখন তাকে মধ্যম পুরুষ বলে। যেমন – তুমি, তোমরা, তুই, তোদের, তোমাদের, আপনি, আপনার ইত্যাদি।

বক্তা যখন অনুপস্থিত কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে তার নামের পরিবর্তে যে সমস্ত সর্বনামের প্রয়োগ করেন তাকে প্রথম পুরুষ বলে। যেমন – সে, তারা, উনি, তিনি, উহারা, যিনি, যারে ইত্যাদি।

দৃষ্টান্ত

‘তিনি তো আমারে দিয়েছিলেন সব। তুমিই কেড়েছ শেষ সম্বল। আমি দুঃখিত নই তাতে। তোমাদের জয় হোক, বললেন উনি।’ – এই উদাহরণ থেকে আমরা তিন প্রকার পুরুষকে বেছে নিতে পারি।

উত্তম পুরুষ – আমারে, আমি

মধ্যম পুরুষ – তুমিই, তোমাদের প্রথম পুরুষ – তিনি, উনি


আমাদের ইউটিউব চ্যানেল

অন্যান্য আলোচনা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *