বাংলা সাহিত্য – কিছু জানা, কিছু অজানা
বাংলা সাহিত্যরসিক মাত্রই জানেন আমাদের বাংলা সাহিত্যে এমন অনেক বিষয় আছে যা কিছু কৌতুহলের উদ্রেক করে। আমরা বাংলা সাহিত্যের অনেক কিছুই জানলেও সবকিছু জানি না। তেমনই কিছু বিষয় নিয়ে আমাদের এই পর্ব। বাংলা সাহিত্য – কিছু জানা, কিছু অজানা এই বিষয় নিয়ে কিছু তথ্য পরিবেশন করা হল এই পোস্টে। আশা করা যায় পাঠক-পাঠিকা এই আলোচনা থেকে কিছু নতুন তথ্য জানতে পারবেন।
বাংলা সাহিত্য – কিছু জানা, কিছু অজানা
১] কবি মাইকেল মধুসুদন দত্ত লিখেছিলেন পত্রকাব্য ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ যাতে এগারোটি পত্র আছে একথা আমাদের জানা কিন্তু আমরা এটা জানি কি এই কাব্যে লিখিত পত্রের উত্তরেও একটি কাব্য লেখা হয়েছিল ? হ্যাঁ, হয়েছিল। তার নাম ‘বীরোত্তর কাব্য’। কাব্যটি লিখেছিলেন গুরুনাথ সেন ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দে। কাব্যের পরিচয় দিতে গিয়ে কবি লিখেছিলেন,
‘বীরোত্তর কাব্য। অর্থাৎ বীরাঙ্গনা-কাব্যে লিখিত পত্রিকা সমূহের উত্তর।’
মোট এগারোটি সর্গে এই কাব্যটি লিখিত। এক একটি সর্গে এক একটি পত্রের অবতারণা করা হয়েছে। কয়েকটি পত্রের শিরোনাম ‘ভানুমতীর প্রতি দুর্য্যোধন’, ‘জনার প্রতি নীলধ্বজ’, ‘শকুন্তলার প্রতি দুষ্মন্ত’ ইত্যাদি। কাব্যটি উৎসর্গ করা হয়েছে, “চির-জীবনানন্দ শ্রীযুক্ত বাবু মহিমচন্দ্র গুপ্ত’কে।
২] ঈশ্বর গুপ্ত শুধু কবি নন, একজন দক্ষ সম্পাদকও বটেন। তাঁর ‘সংবাদ প্রভাকর’ -এর কথা কে না জানে ? কিন্তু এটা জানা আছে কি তিনি একটি নাটকও লিখেছিলেন ? অজানা থাকলে জানিয়ে রাখি, নাটকটির নাম ‘বোধেন্দু বিকাশ’। ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে এই নাটক রচনা করেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। নাটকটির প্রথম প্রকাশ ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায়। নাটকের পরিচয়ে বলা হয়েছে ‘প্রবোধচন্দ্রোদয় নাটকের অনুরূপ’। সংস্কৃত নাটকের মত এই নাটকের ‘নান্দীপাঠ’ করা হয়েছে। নাটকের অঙ্ক সংখ্যা ছয়টি। চরিত্রগুলির নামকরণ করা হয়েছে এরকম – সূত্রধার, নটী, সোমসিদ্ধান্ত, মতি, দম্ভ ইত্যাদি।
আরো কিছু
৩] বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট কাব্যধারা মঙ্গলকাব্যগুলি সম্পর্কে আমরা অনেক কিছুই জানি। আমরা এও জানি যে মোটামুটি পঞ্চদশ শতক থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত এই মঙ্গলকাব্যের ধারা প্রবাহিত হয়েছে। কিন্তু উনিশ বা বিশ শতকে ? তাহলে শুনুন, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে হরিমহিমা বিষয়ক কাব্য ‘মাধব মঙ্গল’ আর বিশ শতকে জগন্নাথ দেবের মাহাত্ম্য বর্ণণা করে লেখা হয়েছে ‘জগন্নাথ মঙ্গল’ কাব্য। ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে উমাচরণ চট্টোপাধ্যায় ‘মাধব মঙ্গল’ লেখেন।। কবি ‘হরি মহীমা’ দিয়ে তাঁর কাব্যের সূচনা করেছেন। কাব্যে উষাবতীর রূপ বর্ণণা, হরি হরের যুদ্ধ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে শ্রীকৃষ্ণের মঙ্গলকথা বর্ণণা করা হয়েছে।
অন্যদিকে ‘জগন্নাথ মঙ্গল’ কাব্যটি রচনা করছেন কবি বিশ্বম্ভর দাস ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে। জগন্নাথদেবের মাহাত্ম্যসূচক নানা গ্রন্থ এবং বিবিধ উপাখ্যান অবলম্বনে কবি এই কাব্যটি লিখেছেন বলে জানিয়েছেন। মোট তিনটি খন্ডে কাব্যটি সম্পূর্ণ। কান্ডগুলির নাম যথাক্রমে ‘সূত্রখন্ড’, ‘লীলাখন্ড’ এবং ‘ক্ষেত্রখন্ড’। কাব্যে মঙ্গলকাব্যের আদলে গুরু, গণেশ, চৈতন্যদেব, জগন্নাথ প্রভৃতি বন্দনা করা হয়েছে। জগন্নাথ দেবের মাহাত্ম্য ও লীলা বর্ণণাই উদ্দেশ্য কবির।
৪] মাইকেলের সুপ্রসিদ্ধ ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ এর কথা সকলেই জানি। কিন্তু এটা জানা আছে কি ‘মেঘনাদবধ নাটক’ও (নাট্য রূপান্তর নয়) লেখা হয়েছিল ? হ্যাঁ, হরিশচন্দ্র শর্মা এই নাটকের প্রণেতা। ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে এই নাটকটি তিনি রচনা করেন। লেখকের ভাষায় ‘নাটক খানি সাধারণ প্রচলিত সরল বাঙ্গালা ভাষায় রচনা‘ করা হয়েছে। নাটকের শুরুতে আছে ‘প্রস্তাবনা’ অংশ। চরিত্রগুলি হল রাম, রাবণ, বীরবাহু, মেঘনাদ, চিত্রাঙ্গদা, সীতা প্রমুখ। নাটকটি উৎসর্গ করা হয়েছে জেমস উইলসন সাহেবকে।
শেষ কথা
৫] আমরা ‘মডেল ভগিনী’র নাম শুনেছি। কিন্তু ‘মডেল কাকা’ ? হ্যাঁ, এই নামেও একটি ব্যঙ্গচিত্র মূলক উপন্যাস লেখা হয়েছিল। ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে এই উপন্যাসটি লেখা হয়। তবে লেখক বা লেখিকার নাম অজ্ঞাত। শুধু গ্রন্থের উৎসর্গপত্রে উল্লেখ আছে ‘শ্রী’। গ্রন্থে বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে গ্রন্থকার লিখেছেন, ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস ও অসৎ সঙ্গে সর্ব্বনাশ’ ইহা জগতে চিরপ্রসিদ্ধ প্রবাদ। এ প্রবাদ মিথ্যা হইলে আমি মডেল কাকার চরিত্র জনসমাজে চিত্রিত করিতে কখনই সক্ষম হইতাম না।” পরিচ্ছেদ বা অধ্যায়ের পরিবর্তে গ্রন্থের কাহিনীভাগ চিহ্নিত করা হয়েছে ‘ধাপ’ নামে। মোট উনচল্লিশটি ‘ধাপে’ গ্রন্থটি সজ্জিত। চরিত্রগুলি হল কৃষ্ণলাল, বসন্তকুমারী, কেতকিনী প্রমুখ। গ্রন্থটি ‘কালীবাবু’কে উৎসর্গ করা হয়েছে।