বাংলা ক্লাসিসিজম
ক্লাসিসিজম হল একটি সাহিত্যিক মতবাদ, একটি সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গি। লোকে যাকে বলে ‘ধ্রুপদী সাহিত্য’। সাধারণতঃ যে সাহিত্যে থাকে সুসংযত রীতি, গাম্ভীর্যপূর্ণ ভাষা, ঐতিহ্যের অনুবর্তন – তাকেই বলে ‘ক্লাসিক সাহিত্য’। আর সাহিত্য সৃষ্টিতে এই ভাব, ভাষা, রীতি ও আদর্শকে গ্রহণ করার নামই হল ‘ক্লাসিসিজম’। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “ক্লাসিক মানে একটি সর্বাঙ্গসুন্দরতার পারফেকসনের ফর্মে অচল প্রতিষ্ঠা।”
“সাহিত্যসন্দর্শন” প্রণেতা শ্রীশচন্দ্র দাস বলেছেন, কবি যখন জগৎ ও জীবনের ভাব চিন্তাকে নিয়মের মধ্যে ধীর স্থির ভাবে প্রত্যক্ষ করেন – তখন তাঁর দৃষ্টি “ক্লাসিক্যাল”। উদাহরণ – এদেশের রামায়ণ, মহাভারত, মেঘনাদবধ কাব্য, বৃত্রসংহার কাব্য (হেমচন্দ্র)। আর পাশ্চাত্যের ইলিয়াড, ওডিসি, ভার্জিলের ‘ইনিভ’, মিলটনের ‘প্যারাডাইস লস্ট’
ক্লাসিসিজম উদ্ভব
ক্লাসিক সাহিত্যের উপর নির্ভর করেই ক্লাসিসিজম -এর জন্ম । সাহিত্যতত্ত্ববিদদের মতে, ক্লাসিসিজম -এর জন্ম প্রাচীন গ্রীসে ও প্রাচীন রোমে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ক্লাসিক কাব্যের ভাবনা প্রথম ধরা পড়ে – পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রদমদিকে বড়ু চন্ডিদাসের “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে” । আর প্রথম ক্লাসিক কাব্য রচনা করেন ঊনবিংশ শতাব্দীতে রেনেসাঁসের কবি মাইকেল মধুসূদন দও। কাব্যটি ছিল – “মেঘনাদবধ কাব্য”।
ক্লাসিসিজম বৈশিষ্ট্য
ক) সৌন্দর্য সৃষ্টির দিকে আগ্রহ
খ) মানব জীবনের গভীর ও সর্বোচ্চ প্রকাশ
গ) প্রত্যক্ষতা ও বাস্তবতা বজায় রেখে ঘটনাবিন্যাস
ঘ) যুক্তিবাদী মননশীলতা ও সামাজিক তীক্ষ্ণতা
ঙ) শব্দের প্রচলিত অর্থ যথাযথ রাখা ।
রোমান্টিসিজম
রোমান্টিসিজম হলো একটি সাহিত্যিক ভাবানুভূতি। এর সংজ্ঞা বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন ভাবে দিয়েছেন। যেমন অধ্যাপক হারফোর্ড বলেছেন – Romanticism is an extraordinary development of imaginative sensibility. অর্থাৎ কল্পনার প্রবণতার অসাধারণ বিকাশই হল রোমান্টিসিজম । আবার হ্যামিলটন বাকল বলেছেন Romanticism has already passed into the realm of the unknowable. ওয়ালটার পেটার বলেছেন – সৌন্দর্য অনুভূতির সঙ্গে তীব্র কৌতুহল বোধের সংযোগটি হল রোমান্টিসিজম। এছাড়া আরো মতামত রয়েছে।
তবে এগুলির মধ্যে সমালোচকেরা হারফোর্ডের সংজ্ঞাটিকেই গ্রহণ করেছেন। ব্রিটেনে ও ফ্রান্সে রোমান্টিক আন্দোলনের পথপ্রদর্শক হলেন কোলরীজ, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, উইলিয়াম ব্লেক প্রমুখ। ‘রোমান্টিক’ শব্দটির উৎস ফরাসি ভাষায় “রোমাঞ্চ” শব্দ যার অর্থ লাতিন শব্দের পরিবর্তে রচনায় গ্রাম্য কথ্য শব্দ প্রয়োগের সাহস। রোমান্টিক সাহিত্যের প্রথম সার্থক নিদর্শন হল কোলরীজ ও ওয়ার্ডসওয়ার্থের মিলিত রচনা “লিরিক্যার ব্যালাডস” (1798)।
উদ্ভব
রোমান্টিসিজমের উদ্ভব ঘটে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে, ইংল্যান্ডে।
বৈশিষ্ট্য
ব্যক্তিনিষ্ঠতা, স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতা, কথ্য ভাষার প্রতি আগ্রহ, নতুন শব্দের ব্যবহার আগ্রহ, আবেগ প্রবণতা, কল্পনা বিলাস, গতিশীলতা, প্রকৃতিপ্রীতি, মানবতাবাদ ইত্যাদি ।
ট্র্যাজেডি
ট্র্যাজেডি হল সেই নাটক, যাতে গূরুগম্ভীর, পূর্ণাঙ্গ, আকর্ষণীয় ঘটনার অনুকরণ থাকে ; যার বিষয় শেষ পর্যন্ত দর্শকের মনে করুণা ও ভয়ের উদ্রেক ঘটায় । অ্যারিস্টটলের মতে, “Tragedy is an imitation , not of men, but of an action, and of life.” (Poetics)
উৎস ও অর্থ
গ্রীক শব্দ ট্রাগোস। যার অর্থ – ছাগ ।
ট্র্যাজেডির বহিরঙ্গ তিনটি – দৃশ্য, গীত, কথা এবং অন্তরঙ্গ তিনটি – প্লট, চরিত্র, ভাবনা ।
ট্র্যাজেডি সাহিত্যের ধারাকে তিন ভাগে ভাগ করা যায় । যথা –
ক. গ্রীক ট্র্যাজেডি
খ. শেক্সপীয়রীয় ট্র্যাজেডি
গ. ইবসেনীয় বা আধুনিক ট্র্যাজেডি ।
অ্যারিস্টটলের মতে ট্র্যাজেডির উপাদান ছয়টি – ক. কাহিনী (Plot), খ. চরিত্র (Character), গ. ভাবনা (Thought), ঘ. রচনারীতি (Diction), ঙ. সংগীত (Melody), চ. দৃশ্যসজ্জা (Spectacle)।
শ্রেণিবিন্যাস
অ্যারিস্টটলের মতে ট্র্যাজেডির শ্রেণিবিভাগ চারটি। যথা –
ক. জটিল ট্র্যাজেডি (Complex)
খ. যন্ত্রণার ট্র্যাজেডি (Pathetic)
গ. নৈতিক ট্র্যাজেডি (Ethical)
ঘ. সরল ট্র্যাজেডি (Simple) ।
ট্র্যাজেডির সাম্প্রতিক শ্রেণীবিভাগ ছয় প্রকার। যথা –
ক. ক্লাসিক্যাল / Classical
খ. রোমান্টিক / Romantic (শেক্সপীয়রের “রোমিও জুলেয়ট”)
গ. ডোমেস্টিক / Domestic (হেনরিক ইবসেনের “A Doll’s House”)
ঘ. হিরোয়িক / Heroic (ড্রাইভেনের “All for Love”)
ঙ. সোস্যাল / Social (গলসওয়ার্দির “Strike”)
চ. পোয়েটিক / Poetic . (জন ড্রিঙ্কওয়াটারের “The God of Quaite”)
বাংলা সাহিত্যে বিখ্যাত কিছু ট্র্যাজেডির উদাহরণঃ মধুসূদন দত্তের “কৃষ্ণকুমারী”, গিরিশচন্দ্রের “প্রফুল্ল”, “বলিদান”, রবীন্দ্রনাথের “রাজা ও রাণী”, “বিসর্জন”, “মালিনী”, দ্বিজেন্দ্রলালের “নূরজাহন”, “সাজাহান”, মন্মথ রায়ের “জীবনটাই নাটক”, “কারাগার”, তুলসী লাহিড়ির “ছেঁড়া তার” ইত্যাদি ।
গ্রীক ট্র্যাজেডির প্রথম লেখক কে হলেন থেসপিস ।
ষোড়শ শতকে বিখ্যাত কিছু ট্র্যাজেডিকার হলেন – মারলো, টমাস কীড, শেক্সপীয়র, চ্যাপম্যান, ফ্লেচার, জনফোর্ড প্রমুখ।
প্রহসন
যে নাটকে স্থুল ভাঁড়ামি ও হাস্য পরিহাসের মধ্য দিয়ে সামাজিক দুর্নীতি-ভন্ডামি-অবিচার কঠিনভাবে ব্যঙ্গ করে শ্রোতাদের স্থুল আমোদ দেওয়া হয় তাকে প্রহসন বলে। মধুসূদন দত্তের “বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ”, “একেই কি বলে সভ্যতা ?”, দীনবন্ধু মিত্রের “বিয়ে পাগলা বুড়ো”, “জামাই বারিক”, “সধবার একাদশী”, গিরিশচন্দ্র ঘোষের “সপ্তমীতে বিসর্জন”, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের “বিরহ”, “কল্কি অবতার”, “প্রায়শ্চিত্ত” ইত্যাদি।
বৈশিষ্ট্য
ক) প্রহসন হল রঙ্গ-ব্যঙ্গ নাটক।
খ) উদ্দাম ও স্থুল হাস্যরস সৃষ্টি।
গ) চরিত্র বড়ো নয় , ঘটনা বড়ো – ঘটনাকে ঘিরেই চরিত্রের প্রকাশ।
ঘ) প্রত্যেকটি চরিত্রই টাইপ প্রকৃতির।
ঙ) কাহিনী হবে বেশ সংক্ষিপ্ত।
উদ্দেশ্য
সামাজিক নীতিভঙ্গকারীদের আচার আচরণের অসংগতি দেখানো, তাদের প্রতি বিদ্রুপের মাধ্যমে হাস্যরস সৃষ্টি করে একই সঙ্গে দর্শককে রসাস্বাদন করানো। আবার মানুষের চারিত্রিক ত্রুটি-বিচ্যুতিক সম্পর্কে সচেতন করা প্রহসনের বিশেষ উদ্দেশ্য।
ওড
ওড হলো স্তোত্র বা প্রশংসামূলক গান । এই প্রশংসা কোনো দেব-দেবীকে হতে পারে আবার কোনো ব্যক্তি বা জাতিকেও হতে পারে অথবা প্রকৃতির কোনো বিষয়কেও হতে পারে। ওড জাতীয় প্রথম গান রচিত হয় গ্রীসে। গ্রীসে কবি পিন্ডার প্রথম ওড রচনা করেন ধর্মীয় আনুষ্ঠানে দেবতাদের তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে। পিন্ডার গ্রীসের বাসিন্দা। তিনি খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চদশ শতাব্দীর মানুষ । পিন্ডারিক ওড লিখে বিখ্যাত হয়েছেন – টমাস গ্রে (The Progress of Poetry) ও আব্রাহাম কাউল (Pindarique Odes)।
ওড কবিতার ধারা তিনটি – পিন্ডারিক ওড, কাউলিয়ান ওড, ও হোরাসিয়ান ওড।
পিন্ডারের ওড কবিতার বৈশিষ্ট্য
ক) এগুলি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে গাইবার যোগ্য।
খ) আকারে যেমন ছোটো , তেমনি ভাবগম্ভীর।
গ) এই গান বহুজনে মিলে গাওয়া হয়।
ইংরাজি সাহিত্যে কিছু ওড জাতীয় কবিতা – ওয়ার্ডসওয়ার্থের “Ode on the Intimation of Immortality”, “Ode to Duty”, শেলীর – “Ode to the West wind”, “Ode to Liberty”, “Ode to Naples”, কীটসের “Ode to a Nightingale”, “Ode on a Grecion Urn”, “Ode to Psyche”, “Ode on a Melancholy”, “Ode to Autumn” ইত্যাদি ।
বাংলা সাহিত্যে কিছু ওড জাতীয় কবিতা – হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের – “ভারতভিক্ষা”, ভারতবিলাপ”, “ভারত সঙ্গীত”, দেবেন্দ্রনাথ সেনের “বর্ষামঙ্গল”, অক্ষয়কুমার বড়ালের “মানব বন্দনা”, রবীন্দ্রনাথের “বর্ষশেষ”, “উর্বশী”, “পৃথিবী”। ইত্যাদি ।