দ্বিজেন্দ্রলাল রায় – জীবন ও সাহিত্য
বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩ – ১৯১৩) এক উল্লেখযোগ্য নাম। শুধু নাটক রচনাই নয়, তাঁর লেখা গান বাঙালির হৃদয় ছুঁয়ে যায়। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় – জীবন ও সাহিত্য পোস্টে নাট্যকারের পরিচিতি সহ বাংলা সাহিত্যে তাঁর অমূল্য অবদান তুলে ধরা হয়েছে।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় – পরিচিতি
১৮৬৩ খ্রীস্টাব্দের ১৯ শে জুলাই নদীয়ার কৃষ্ণনগরের প্রসিদ্ধ দেওয়ান বংশে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ছিলেন কার্তিকেয়চন্দ্র রায়। মাতা প্রসন্নময়ী দেবী। চরিত্রমাহাত্ম্যে ও বাংলা – ইংরাজী – ফার্সী ভাষায় পারদর্শিতার জন্য কার্তিকেয়চন্দ্র বিদ্যাসাগর – মধুসূদন – দীনবন্ধু – বঙ্কিমচন্দ্র প্রমূখ ব্যক্তিত্বের বন্ধুত্ব লাভ করেন। দ্বিজেন্দ্রলাল ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরাজী সাহিত্যে দ্বিতীয় শ্রেণীতে প্রথম হয়ে এম. এ. পাশ করেন। সম্পাদনা করেছেন ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার।
বাংলা সাহিত্যে অবদান
দ্বিজেন্দ্রলাল বাংলা সাহিত্যে আবির্ভাব ঘটে কবি এবং নাট্যকার রূপে। তিনি বাংলা কবিতায় আনতে চেয়েছিলেন ইন্দ্রিয়াবেগের প্রত্যক্ষ স্ফূর্তির সঙ্গে সামাজিক বাস্তববুদ্ধি। বাংলা কবিতায় ইংরেজী শব্দ বসিয়ে মৌখিক রীতি প্রবর্তনেও তাঁর কৃতিত্ব দেখা যায় । বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত না হলেও জন-গন-মন হরণে সক্ষম হন নাট্যকাররূপে। এই ভাবে প্রহসন, তারপর পৌরাণিক, ঐতিহাসিক ও সামাজিক নাটক রচনায় দ্বিজেন্দ্রলালের নাট্যপ্রতিভা বিকশিত হয়।
কাব্যগ্রন্থ ও তার বিষয়
১. “আর্যগাথা” (১ম – ১৮৮২, ২য় – ১৮৯৩) – এই কাব্যের ১ম ভাগে আছে ঈশ্বর – প্রকৃতি আত্মানুভূতর বিষয়ে সমৃদ্ধ। আর ২য় ভাগে আছে মানবপ্রেমের প্রকাশ।
২. “The Lyrics of Ind” (১৮৮৬) – এই কাব্যের মধ্য দিয়ে ইংরেজী ভাষার কাব্যভাবনার মিলনসূত্র রচনা করতে চেয়েছিলেন।
৩. “আষাঢ়ে” (১৮৯৯) ,- এই কাব্যটি ইংরেজী ব্যঙ্গকাব্যের অনুসরণে রচিত ।
৪. “হাসির গান” (১৯০০) – এই কাব্যটিও বারহামের “Ingoldsby Legend’s” এর দ্বারা অনুভাবিত। কাব্যটির মধ্য দিয়ে বাঙালী সমাজে একটা ভাবের বিপ্লব ঘটিয়েছিল।
৫. “মন্দ্র” (১৯০২) – এই কাব্যে দেখা যায় গীতিকার এবং তার্কিক কবি-চিত্তে দুই স্ববিরোধী সত্ত্বার অবস্থান।
৬. “আলেখ্য” (১৯০৭) – এর একদিকে আছে স্ত্রী বিয়োগের অভিজ্ঞতা, অন্যদিকে আছে নতুন সমাজভাবনা ও গনতান্ত্রিক চেতনা।
৭. “ত্রিবেণী” (১৯১২) – কাব্যটি স্থির গম্ভীর স্মৃতির বেদনায় পূর্ণ। এখানে যেমন আছে অতীত স্মৃতির পর্যালোচনা, তেমনি আছে জগৎ ও জবনের নতুনতর অর্থের তৃষ্ণা।
কাব্য – সংক্রান্ত প্রবন্ধ
“কাব্যের অভিব্যক্তি” ( ১৩১৩, কার্ত্তিক ‘প্রবাসী’ ), “কাব্যের উপভোগ” ( ১৩১৪, মাঘ ‘বঙ্গদর্শন’ ), “কাব্যের নীতি” ( ১৩১৬, জ্যৈষ্ঠ ‘সাহিত্য’ ) ।
প্রহসন ও তার বিষয়
১. “এক ঘরে” (১৮৮৯) – ১৮৮৭ খ্রীস্টাব্দে বিলেত থেকে দেশে ফেরাল পর বিনা প্রায়শ্চিত্তে হিন্দুসমাজ তাঁকে গ্রহণে অসম্মত হয়। সমাজের এই অন্যায় ব্যবহারের প্রতিক্রিয়ায় এই রচনা প্রকাশিত হয় ।
২. “কল্কি অবতার” (১৮৯৫) – এ নব্যহিন্দু , ব্রাহ্ম , রক্ষণশীল, পন্ডিত ও বিলাত-ফেরত – এই পাঁচ সম্প্রদায়ের প্রতি ব্যঙ্গবাণ নিক্ষিপ্ত হয়েছে।
৩. “বিরহ” (১৮৯৭) – এতে আখ্যান বিন্যাস যথেষ্ট জটিল। সামাজিক বিদ্রুপ অনেক কম ।
৪. “ত্র্যহস্পর্শ” (১৯০১) – এটি তেমন সার্থক হতে পারেনি ।
৫. “প্রায়শ্চিত্ত” (১৯০২) – এতে আছে বিলাত ফেরত সমাজের অর্থলোলুপতা – কৃত্রিমতা – বিলাসিতা র বিরুদ্ধে বিদ্রুপ বর্ষণ।
৬. “পুনর্জন্ম” (১৯১১) – এতে এক কৃপণ , নির্মম ও স্বার্থপর সুদখোরের হাস্যকর পরিণতি দেখানো হয়েছে।
৭. “আনন্দ-বিদায়” (১৯১২) – রবীন্দ্র বিরোধিতার এক উজ্জ্বল স্মৃতিখণ্ড আছে এই প্রহসনে ।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় নাটক
পৌরাণিক নাটক ও তার বিষয়
১. “পাষাণী” (১৯০০) – এতে অভিশাপের প্রভাবে অহল্যার পাষাণ হওয়ার কাহিনী পরিব্যপ্ত ।
২. “সীতা” (১৯০৮) – এর কাহিনী ভবভূতির ‘উওর রামচরিত’ এবং বাল্মীকি রামায়ণের উওরকান্ড থেকে গৃহীত । এতে রাম ও সীতার অনেক উক্তি বিচ্ছিন্ন গীতিকবিতা বলে ভ্রম হওয়া অস্বাভাবিক নয় ।
৩. “ভীষ্ম” (১৯১৪) – এই নাটকটি মহাভারতের সর্বাংশে অনুকরণ নয় ।
ইতিহাসাশ্রিত রোমান্টিক কাব্য ও তার বিষয়
১. “তারাবাঈ” (১৯০৩) – মোগল – রাজপুত সম্পর্ক অবলম্বন করে এই নাটক রচিত ।
২. “সোরাব রুস্তম” (১৯০৮) – ফিদৌসির ‘শাহনামা’ গ্রন্থটি এর মূল উৎস । এখানে আফ্রিদ চরিত্রে দেশপ্রেমের দিকটি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ।
ঐতিহাসিক নাটক ও তার বিষয়
১. “রাণা প্রতাপসিংহ” (১৯০৫) “দুর্গাদাস” (১৯০৬) , “মেবার-পতন” (১৯০৮) – এই তিনটি নাটকে রাজপুতদের বীরত্ব , আত্মমর্যাদা ও দেশপ্রেমের ছবি পরিস্ফুট হয়েছে ।
২. “নূরজাহান”(১৯০৮) “সাজাহান” (১৯০৯) – এই নাটকদ্বয়ে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর এবং সিজাহানের পরিবারের কলঙ্কের ঘটনা বর্ণিত আছে ।
৩. “চন্দ্রগুপ্ত” (১৯১১) , “সিংহলবিজয়” (১৯১৫) – প্রাচীন ভারতের হিন্দুযুগ থেকে বিষয় নির্বাচন করে এই দুই নাটক দ্বিজেন্দ্রলাল রচনা করেন ।
সামাজিক নাটক
“পরপারে” (১৯১২) , “বঙ্গনারী” (১৯১৫) ।
মূল্যায়ন
তাঁর রচনার মধ্যে সবসময় একটা নতুনত্বের সন্ধান পাওয়া গেছে । তিনি কাব্যের মধ্য দিয়ে গদ্যময় সংলাপ প্রচলন করেছেন । নাটকের মধ্যে আধ্যাত্মিকতা ও অলৌকিকতা বর্জন করে আধুনিক জীবনভাবনার প্রকাশ করেছেন । তাই , বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কবি এবং নাট্যকার হিসেবে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ব্যক্তিত্বকে অবিস্মরণীয় বলা যেতেই পারে ।
khub sundor, upokrito hochhi. dhynobad roilo. r egie cholar jonno anek suvechha.