বাংলা সাহিত্যের পরশুরাম – রাজশেখর বসু
সাহিত্য পাঠ করতে গেলে সাহিত্যেক সম্পর্কে এবং নির্দিষ্টভাবে পাঠ্য বিষয়ের উপর অনুপুঙ্খভাবে জানতে হয় l কারণ কোনো লেখা বা বই আকাশ থেকে পড়ে না l একজন লেখক তাঁর রচয়িতা l সেই লেখক ও তাঁর সমাজ ও সময়ের প্রতিনিধি ও প্রতিবেদক l লেখকের পরিপার্শ্বই তাঁর সৃষ্টিকর্মের চরিত্রকে মূলত নির্মাণ করে, তাঁর ওপর পড়ে লেখকের ব্যক্তিসত্তা ও সাহিত্যসত্তর প্রভাব l রাজশেখর বসু ওরফে পরশুরামের গল্প যেন একটা জগত l এই বিশিষ্ট জগতের স্রষ্টা তার লেখক l সেই জগতের অন্তর্বর্তী চরিত্রগুলি তাঁরই সাহিত্যপ্রতিভা দ্বারা অঙ্কিত l
রাজশেখর বসু জন্ম ও বংশ পরিচয়
১৮৮০ খৃষ্টাব্দের ১৬ই মার্চ ( ১২৮৬ বঙ্গাব্দের ৪ঠা চৈত্র ) বর্ধমান জেলার শক্তিগড়ের সন্নিকটস্থ বামুনপাড়া গ্রামে তাঁর জন্ম l বামুন পাড়া হচ্ছে রাজশেখরের মামাবাড়িl আর পিতৃক নিবাস নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরের নিকটবর্তী উলা বীরনগর l পিতা দার্শনিক পণ্ডিত চন্দ্রশেখর দ্বারঅঙ্গা রাজ এস্টেটের ম্যনেজার ছিলেন l চন্দ্রশেখর বসুর চার পুত্র :শশীশেখর, রাজশেখর, কৃষ্ণশেখর, গিরীন্দ্রশেখর l চন্দ্রশেখরের জন্ম ১৮৩৩খৃষ্টাব্দ l
রাজশেখর বসু – শিক্ষা জীবন
রাজশেখরের বাল্যকাল পিতার সঙ্গে বাংলার বাইরে কেটেছে l প্রথম সাত বত্সর তিনি মুঙ্গের জেলার খড়নপুরে কাটান l তার পর থেকে ১৮৮৮ থেকে ১৮৯৫ পর্যন্ত দ্বারভাঙ্গার রাজ স্কুলে পড়ে এন্ট্রাস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন l দ্বারভাঙ্গার স্কুলে রাজশেখরই একমাত্র বাঙালি ছাত্র ছিলেন l বাল্যকালে তাঁর পিতার নিয়মনিষ্ঠা প্রভৃতি সদ্গুণের দ্বারা রাজশেখর এবং তার ভ্রাতৃগণ প্রভাবান্বিত হন l ১৯৮৫-৯৭খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজশেখর পাটনা কলেজে ফর্স্ট আর্টস পড়েন l
এই সময় রাজেন্দ্রপ্রসাদের (প্রথম রাষ্ট্রপতি) জ্যেষ্ঠভ্রাতা মহেন্দ্র প্রসাদ তাঁর সহপাঠী ছিলেন l পাটনা কলেজে তাঁর সঙ্গে আরও জন -দশেক বাঙালি ছাত্র পড়তেন l সে মহলে সাহিত্য -আলোচনা হত, তবে তা তেমন দানা বেঁধে উঠতে পারেনি l বাঙালি তখন হেম -মধু -বঙ্কিমের প্রভাব -প্রতিপত্তির আওতায় চলছিল l রবীন্দ্রনাথের কবিখ্যাতি হয়েছে, তবে সেরকম প্রকট হয়নি l ১৮৯৭খৃষ্টাব্দে রাজশেখর পাটনার পর্ব চুকিয়ে কলকাতায় বি.এ পড়বার জন্য এলেন, প্রেসিডেন্সি কলেজের বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হলেন l এই বছরই তার বিবাহ হয় l তাঁর পত্নী মৃণালিনী দেবী ছিলেন শ্যামাচরণ দে -র পৌত্রীl রাজশেখর ও মৃণালিনীর সন্তান বলতে একমাত্র কন্যা প্রতিমা l
আরও পড়ুন
প্রেসিডেন্সি কলেজে রাজশেখর যখন পড়ে সে সময়ে শ্রী হেমচন্দ্র প্রসাদ ঘোষ ও পড়তেন, তবে হেমেন্দ্রবাবু আর্টসের ছাত্র ছিলেন l রাজশেখরের সতীর্থদের মধে শরৎচন্দ্র দত্ত পরবর্তী কালে জার্মানি থেকে বিশেষ শিক্ষা লাভ করে দেশে ফিরে “এডেয়ার ডাট” নামে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন l আচার্য্য জগদীশ চন্দ্র বসুর কাছে রাজশেখর সামান্য কিছুদিন বি.এ তে পড়েছেন l অনেকের ধরনা আছে যে, তিনি আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ছাত্র, এ ধরনা ভুল l
অবশ্য পরবর্তী জীবনে প্রফুল্লচন্দ্রের সাহচর্যে রাজশেখর উপকৃত হয়েছিলেন l ১৮৯৯ খৃষ্টাব্দে তিনি কেমিস্ট্রি ও ফিজিক্সে দ্বিতীয় শ্রেণির অনার্স নিয়ে বি.এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন l এর এক বছর পরে অর্থাৎ ১৯০০খৃষ্টাব্দে রসায়ন শাস্ত্রে প্রথম স্থান অধিকার করে রাজশেখর এম.এ পরীক্ষায় সগৌরবে উত্তীর্ণ হলেন l পাটনা ও কলকতায় থাকবার সময়েও দ্বারভাঙ্গার সঙ্গে তাঁর যোগযোগ অব্যাহত ছিলো l এম.এ পাশ করার দু-বছর পরে আইন অধ্যয়ন সমাপ্ত করে বি.এল পরীক্ষাটিও পাশ করে ফেললেন l
এরপর স্বভাবতই হাইকোর্টে আইন ব্যবসায়ের উদ্যোগ করবার কথা l কিন্তু মাত্র তিন দিনেই আদালতে পসরা জমাবার মধ্যমে জলাঞ্জলি দিয়ে বসলেন l রাজশেখর প্রকৃতিগতভাবেই সত্ এবং ভদ্র l তিনি সংযত শান্ত এবং অন্তর্মুখী l তাঁকে দিয়ে গবেষণাদির চিন্তাপ্রধান কাজই ভালো হতে পারে, একথা তিনি নিজেও বুঝেছিলেন l
কর্মজীবন
রাজশেখর গল্পকার হলেও, মূলে কিন্তু তিমি ছিলেন একজন বিজ্ঞানী l ১৯০৩ সালে আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সঙ্গে সাক্ষাত হলো এবং রাজশেখর বেঙ্গল কেমিকেল ওয়ার্কসে রসায়নকের পদে বহাল হলেন l তখন সার্কুলার রোডে বেঙ্গল কেমিকেলের অফিস ছিলl বর্তমান বেঙ্গল কেমিক্যালের অফিস চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউতে অবস্থিত l প্রথমে রাজশেখর কিছুকাল বেচু চাটুজ্জে স্ট্রিটের ভাড়াবাড়িতে, তারপর পারশীবাগানের পৈতৃক গৃহে অবস্থান করেন l
কাজে বহাল হওয়ার এক বছরের মধ্যেই তিনি উক্ত প্রতিষ্ঠানের ম্যনেজার হলেন l এবং ১৯০৬ সালে তিনি বেঙ্গল কেমিকেলের সর্বময় কতৃত্বের ভার গ্রহণ করেন l সেই থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত এই স্বদেশী প্রতিষ্ঠানটির প্রভূত উন্নতি সাধন করে অবসর গ্রহণ করেন l অবশ্য এখনও পরোক্ষভাবে বেঙ্গল কেমিক্যাল তাঁর কাছে পরামর্শ গ্রহণ করে থাকেন l (গৌরীশংকর ভট্টাচার্য্য ” কথাসাহিত্য ” রাজশেখর বসু সংবর্ধনা সংখা, শ্রবণ ১৩৮০)
সাহিত্যকর্ম
হাস্যরসে নিপুণ শিল্পী রাজশেখর বসু “পরশুরাম” ছদ্মনামে ছোটগল্পে স্মরণীয় l পরশুরামের গল্পগ্রন্থ :
(১) গড্ডলিকা (২) কজ্জলী, (৩) হনুমানের স্বপ্ন (৪) গল্পকল্প (৫) ধুস্তরী মায়া (৬) কৃষ্ণকলী (৭) নীলতারা (৮) আনন্দীবাঈ (৯) চমত্কুমারী। এই নয়টি গল্প গ্রন্থে গল্পের সংখা- ৯৭।