অন্যান্য সাহিত্যিক

কবিতা সিংহ

কবি কবিতা সিংহ – বাংলায় নারীবাদী রচনার অন্যতম স্রষ্টা। তিনি কবিতার সাথে সাথে ছোটোগল্প এবং উপন্যাসও রচনা করেছেন । তিনি সুলতানা চৌধুরী ছদ্মনামেও লিখেছেন। এই আলোচনায় কবির জীবন ও সাহিত্য সম্পর্কে মূল্যবান নানা তথ্য পাবেন পাঠক-পাঠিকা।

কবিতা সিংহ – কবি পরিচিতি

কবিতা সিংহ -এর জন্ম ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ অক্টোবর, কলকাতায় ভবানীপুরে। ছয়-সাত বছর বয়স থেকেই তিনি লিখতে আরম্ভ করেন। তাঁর থেকে মাত্র পনেরো বছরের বড়, তাঁর মা অন্নপূর্ণা সিংহকে কবিতা লিখতে দেখতেন তিনি।

মাকে দেখেই তাঁর ছবি আঁকতে শেখা। কিন্তু মায়ের মতো পিয়ানো এবং অর্গান বাজাতে শেখেননি তিনি। বাবা শৈলেন্দ্র সিংহ সেতার বাজাতেন। তা-ও শেখা হয়ে ওঠেনি তাঁর। মায়ের উৎসাহে নাচ শেখেন কবিতা। ষোলো বছর বয়স পর্যন্ত তিনি নাচ শিখেছিলেন। কবিতা সিংহ মনে করতেন, নাচ আর ছবি আঁকাই তাঁর জীবনে দান করেছে ছন্দ আর বর্ণ। দিয়েছে শরীরের স্ফূর্তি, স্বাধীন বিকাশের আনন্দ। কবিতার জীবনের অনেকখানি, বোধহয় সবখানি জুড়েই ভাস্বর হয়ে ছিল তাঁর মায়ের ছবি, তাঁর জীবনে যার সবথেকে বেশি প্রভাব ছিল।

কবিতা সিংহ – শিক্ষা ও কর্মজীবন

মূলত কবিতা রচনার মধ্য দিয়েই তিনি নিজের কবিসত্তার প্রকাশ ঘটান। কবিতা সিংহ এর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ১৯৪৬ সালে, পনেরো বছর বয়সে। যা প্রকাশিত হয় “নেশন পত্রিকায়”। তবে এটি ছিল তার ইংরাজি কবিতা। কবিতা সিংহের কাব্যের কোনো ঈশ্বর নেই, আছেন ঈশ্বরী। তিনি একা। নারী এবং কবিতাকে একইসঙ্গে মিলিয়ে দেন কবিতা সিংহ। কাব্যের দেবী কবিকে দেখিয়ে দেন কবিতার অবয়ব। নারীর গর্ভধারণ এবং কবিতার জন্ম হওয়া কোথাও যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় কবির কাছে। কবিতা যখন কবির কাছে আসেন, তখন কবি যেমন অনেক কিছু পান, তেমনি জীবনের সাধারণ- স্বাভাবিক অনেক কিছু ছাড়তে হয় তাঁকে। তাঁকে পেতে হয় নির্বাসন। তেমনি মেয়েরা যখন প্রাবল্য ধারণ করে, উন্নতির শিখরে উঠে চলে, তখনই
তাঁকে মনে করা হয় অশুভের প্রতীক। জ্ঞান- বুদ্ধির শক্তি থেকে বিযুক্ত করা হয় তাকে। আর তাই ‘ঈশ্বরী কাব্যের যিনি, সাকার তমসা তিনি/ তিনি ঘোর অমা!’

রচনা

তিনি সুলতানা চৌধুরী ছদ্মনামে লেখা লিখেছেন। তাঁর কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা মূলত ৩ টি। যথা- “সহজ সুন্দরী”(১৯৬৫), “কবিতা পরমেশ্বরী “(১৯৭৬), ” হরিণাবৈরী ” (১৯৮৩)।
কবিতা লেখার বাইরে তিনি কিছু ছোটোগল্প এবং উপন্যাস রচনা করেন, যদিও সেগুলি তেমন শিল্প মাধুর্য সৃষ্টি করতে পারেনি। তাঁর লেখা রচনা গুলি হল- “সোনারুপার কাঠি” (১৯৫৬),”পাপপুন্য পেরিয়ে” (১৯৬৪), “চারজন রাগী যুবতী “(১৯৭৩) , “নায়িকা প্রতিনায়িকা ” (১৯৭৯), “মোমের তাজমহল” প্রভৃতি।

মঞ্জুশ্রী সান্যাল “কবিতা সিংহের কবিতা” প্রবন্ধে লিখেছেন – “পঞ্চাশের দশকের নারী মাধুর্যের মোহাঞ্জন মুছে ফেলে সত্যের পরাক্রমী উচ্চারণে পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে দৃঢ় দ্রোহ নিয়ে কবিতার মঞ্চে যিনি আলোড়ন সৃষ্টি করলেন তিনিই কবিতা সিংহ। তার এই প্রতিবাদ মুখর কণ্ঠস্বর সেই যুগের কাব্যভূমিতে ছিল এক ব্যতিক্রমী নিদর্শন। ”

কবিতা সিংহের কবিতায় প্রতিবাদী মেয়ের কণ্ঠস্বর বারে বারেই ধ্বনিত হয়। কবিতা সিংহের কবিতায় শোনা যায় সমাজের নানাধরনের পীড়নের বিরুদ্ধে স্বর। যেমন – দলিত সত্তার প্রতি অবিচারের প্রতিস্পর্ধী স্বর, যৌনতার রাজনীতি-অভিসন্ধির প্রত্যুত্তর, শ্রেণিবৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের স্বর। সমাজের নারী-পুরষের বৈষম্যের বিপক্ষে প্রতিবাদ স্পষ্টভাবে বলতে পারেন তিনি।
একইসঙ্গে তিনি দেখান – দলিত সমাজের মেয়েদের কীভাবে পুরুষদের থেকে দ্বিগুণ বেশি যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়। শ্রেণি এবং লিঙ্গ – দুটি পরিচয়ই তাদের রক্তমজ্জায় সঞ্চারিত করে দেয় অশৌচ, জীবনের সহজ, স্বাভাবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত তারা। তাদের চাওয়া-পাওয়া – সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হয় তথাকথিত উচ্চবর্ণের মানুষের দ্বারা। তারা বোঝে – ‘নিজের আজন্ম পাপ জন্ম
অস্পৃশ্যতা।’ কণ্যা ভ্রূণ নষ্ট করা নিয়েও তিনি প্রতিবাদ জানান। তিনি লেখেন -: “আমরা ভ্রূণ না ভ্রূণা/ জন্ম দিও না মা/ মা আমার জেনে শুনে কখনো উদরে/ ধরো না এ বৃথা মাংস ”

মূল্যায়ন

সাহিত্যিক নবনীতা দেবসেনের মন্তব্যও প্রনিধানযোগ্য। তিনি বলেন-” কবিতা সিংহ যে সকল দিক থেকে একমেবদ্বিতীয়ম,বাংলা সাহিত্যে তাঁ্র কোনো তুলনা নেই। আজকের নারীবাদীদের চেয়ে অনেক বেশি পথ হাঁটতে হয়েছিল তঁাকে। আর এগিয়ে ছিলেন যোজন যোজন বেশি।” [ ‘একান্তর’,১৯৯৯,জানুয়ারি]

শুধুমাত্র কবি হিসাবেই যে তার খ্যাতি ছিল তা নয় তিনি আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে বাংলা কথিকা বিভাগের সহকারী প্রযোজিকা হিসাবে যোগ দেন এবং জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। অবশেষে ১৯৯৮ সালে তিনি পরলোকগমন করেন।

আলোচক – সুকান্ত চ্যাট্টার্জী, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়।

তথ্যসূত্র-

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস – তপন কুমার চট্টোপাধ্যায়।
কালি ও কলম ( সাহিত্য,শিল্প,সংস্কৃতি বিষয়ক মাসিক পত্রিকা)।
ইন্টারনেট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *