ধ্বনিতত্ত্ব

ধ্বনি ভাষার ভিত্তি

ধ্বনি ভাষার ভিত্তি – যে কোন ভাষার মূল একক হলো তার ধ্বনি বা বর্ণ l এক একটি ধ্বনি বা বর্ণ যুক্ত হয়ে একটি অর্থবোধক শব্দে পরিণত হয়, এক একটি শব্দ মিলে তৈরি হয় বাক্য আর অনেকগুলি বাক্য মিলে তৈরি হয় কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক, গান, উপন্যাস ইত্যদি l একটি চলমান মনুষ্য সভ্যতা,তার চলমান জীবন প্রবাহে ভাব বিনিময়ের প্রধান যে মধ্যম তা হলো ভাষা l আর সেই ভাষার যে মূল বীজ তাই-ই হলো ধ্বনি l

আমদের বাংলা ভাষা বিজ্ঞানে “ধ্বনি এবং তার পরিবর্ত “একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচিত বিষয় l এবার আমরা সংক্ষেপে জেনে নিতে চেষ্টা করবো ধ্বনির সাতকাহন, ধ্বনি ভাষার ভিত্তি এই আলোচনায়।

ধ্বনি ভাষার ভিত্তি

ধ্বনি – বাগযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত মুখনিঃসৃত অর্থবোধক আওয়াজকেই সাধারণত ধ্বনি বলা হয় l আর সেই ধ্বনির লিখিত রূপের নাম বর্ণ l

ধ্বনির রকমফের – উচ্চারণের দিক থেকে সমস্ত ধ্বনি দু’ভাগে বিভক্ত l যথা -১) স্বরধ্বনি ২) ব্যঞ্জন ধ্বনি l

১) স্বরধ্বনি:- যে সমস্ত ধ্বনি উচ্চারণে শ্বস্ বায়ু মুখের ভেতর কনও রকম বাধা পায় না, তাকে স্বরধ্বনি বলে l যেমন – অ আ ই ঈ উ ঊ ঋ এ ঐ ঔ এরা কারো তোয়াক্কা না করে সটান গলা থেকে বেরিয়ে আসে l কেউ তাদের বাধা দেয় না l

ধ্বনি ভাষার ভিত্তি – স্বরধ্বনির বৈচিত্র্য

১) যে স্বরধ্বনিগুলো উচ্চারণে কম সময় লাগে সেইগুলোর নাম হ্রস্বস্বর : অ ই উ ঋ
২) যে স্বরধ্বনিগুলো উচ্চারণে সময় একটু বেশি লাগে সেগুলোর নাম ধীর্ঘস্বর : আ ঈ ঊ এ ঐ ও ঔ

বাংলা ব্যাকরণে আবার স্বরধ্বনিকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা হয় –
১) মৌলিক স্বরধ্বনি – যে স্বরধ্বনি ভাঙ্গা বা বিশ্লেষণ করা যায় না, তাকে বলে মৌলিক স্বরধ্বনিl
যেমন – অ আ ই উ এ অ্যা ও

২) যৌগিক স্বরধ্বনি- যে স্বরধ্বনির মধ্যে দুটি স্বরধ্বনি যুক্ত অবস্থায় থাকে তাকে বলে l যেমন – ঐ =ও +ই, ঔ = ও +উ l এইভাবে যুক্ত হয়ে থাকে বলে এঁদের সন্ধি স্বরধ্বনি বা যুগ্ম স্বরধ্বনিl

অতিরিক্ত স্বরধ্বনি- অর্ধস্বর ধ্বনি – যে স্বরধ্বনি জোট গঠন করতে পারে না, কিন্তু জোট গঠনে সাহায্য করতে পারে তাদের বলে অর্ধস্বর ধ্বনি l
যেমন – আও -খাও (আ পূর্ণ উচ্চারিত ও অর্ধরূপে উচ্চারিত )
অনুরূপ ভাবে – আই -যাই, ওউ -কেউ, ওয়- শোয়

স্বরধ্বনির উচ্চরণগত বিভাগ ও বিশ্লেষণ

১) জিহ্বা কেন্দ্রীক উচ্চরণ –
ক ) ঊর্ধ্ব স্বরধ্বনি: যে -স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময় জিহ্বা ওপরের দিকে উঠে আসে তাকে ঊর্ধ্ব স্বরধ্বনি বলে l
যেমন- ই ঈ উ ঔ

খ ) নিম্ন স্বরধ্বনি- যে -স্বরধ্বনি উচ্চরণের সময় জিহ্বা নীচের দিকে নেমে আসে তাকে নিম্ন স্বরধ্বনি বলে l
যেমন – আ

গ ) নিম্ন – মধ্য স্বরধ্বনি- যে -স্বরধ্বনি উচ্চরণের সময় জিহ্বা নিন্ম স্বরধ্বনির অবস্তান থেকে সমান্য ওপরের দিকে থাকে l
যেমন – অ অ্যা

ঘ ) উচ্চ -মধ্য স্বরধ্বনি:যে স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময় জিহ্বা ঊর্ধ্ব স্বরধ্বনি থেকে সমান্য নীচে অবস্থান করে তাকে উচ্চ -মধ্য স্বরধ্বনি বলে l
যেমন – এ ও

ঙ) সম্মুখ স্বরধ্বনি- যে -স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময় জিহ্বা সামনের দিকে এগিয়ে আসে তাকে সম্মুখ স্বরধ্বনি বলে l
যেমন – ই এ অ্যা

চ )পশ্চাত্ স্বরধ্বনি- যে -স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময় জিহ্বা পেছনের দিকে সরে যায় তাকে পশ্চাত্ স্বরধ্বনি বলে l
যেমন – অ উ ও

ছ ) কেন্দ্রীয় স্বরধ্বনি- যে -সমস্ত স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময় জিহ্বা এগিয়ে আসে ন বা পিছিয়েও যায়না তাকে কেন্দ্রীয় স্বরধ্বনি বলে l
যেমন -অ

২) ঠোঁট কেন্দ্রীক উচ্চরণ –
ক ) কুঞ্চিত স্বরধ্বনি- যে স্বরধ্বনি উচ্চরণের সময় ঠোঁট দুটি কুঁচকে যায় তাকে কুঞ্চিত স্বরধ্বনি বলে l
যেমন – অ উ ও
এই স্বরধ্বনি গুলি উচ্চারণের সময় ঠোঁটের আকৃতি গোল বা বর্তুলাকার হয়ে যায় বলে একে বর্তুল স্বরধ্বনিও বলা হয় l

খ ) প্রসিত স্বরধ্বনি- যে স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময় ঠোঁট দুটি পাশে বেড়ে যায় বা প্রসারিত হয়ে যায় তাকে প্রসিত স্বরধ্বনি বলে l
যেমন – ই এ অ্যা

৩) মুখবিবর কেন্দ্রীক উচ্চরণ –
ক ) বিবৃত স্বরধ্বনি- যে -স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময় মুখবিবর একেবারে ‘হাঁ ‘ করা বা বিবৃত অবস্থায় থাকে তাকে বিবৃত স্বরধ্বনি বলে l
যেমন – আ
খ ) অর্ধ -বিবৃত স্বরধ্বনি- যে সমস্ত স্বরধ্বনি সময় মুখবিবর অর্ধেকটা ‘হাঁ ‘ করা অবস্থায় থাকে তাকে অর্ধ -বিবৃত স্বরধ্বনি বলে l
যেমন – অ, অ্যা
সংবৃত স্বরধ্বনি- যে -স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময় মুখ বিবরটি সব থেকে প্রসারিত বা সব থেকে সংকোচিত অবস্থায় থাকে তাকে বলে সংবৃত স্বরধ্বনিl
যেমন – ই ( মুখ বিবর সব থেকে প্রসারিত) উ ( মুখ বিবর সব থেকে সংকোচিত )
ঘ ) অর্ধ -সংবৃত স্বরধ্বনি- যে স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময় মুখবিবরটি অর্ধ ভাবে প্রসারিত বা সংকোচিত l
যেমন -এ (মুখবিবর অর্ধভাবে প্রসারিত ) ও ( অর্ধভাবে সংকোচিত)

ধ্বনি ভাষার ভিত্তি – কিছু প্রশ্ন

১) মৌলিক স্বরধ্বনি কী ?
উঃ- যে সকল স্বরধ্বনিকে বিশ্লিষ্ট করা যায় না এবং যারা অন্য কোনো ধ্বনির সঙ্গে সাদৃশ্য পূর্ণ নয় , তাদেরই মৌলিক স্বরধ্বনি বলে ।

২) বাংলায় মৌলিক স্বরধ্বনির সংখ্যা কয়টি ?
উঃ- সাতটি । যথা – ই, এ, আ, অ, ও, উ, অ্যা ।

৩) শ্রেণীবিভাগ : – দুই দিক থেকে শ্রেণীবিভাগ করা হয় । যেমন – জিহ্বার অবস্থান অনুযায়ী এবং মুখবিবরের আকৃতির পরিবর্তন অনুযায়ী ।

৪)  জিহ্বার অবস্থান অনুযায়ী শ্রেণীবিভাগ ?
উঃ- জিহ্বার অবস্থান অনুযায়ী মৌলিক স্বরধ্বনিকে সাত ভাগে করা হয় । যেমন –

ক) সম্মুখ স্বরধ্বনি :- ই, এ, আ, অ্যা – এই চারটি স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময় জিহ্বা সম্মুখ দিকে আকৃষ্ট হয় , তাই এর এমন নাম।

খ) পশ্চাৎ স্বরধ্বনি :- অ, ও, উ – এই তিনটি স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময় জিহ্বা পশ্চাৎ দিকে আকৃষ্ট হয় , তাই এর এমন নাম ।

গ) উচ্চ স্বরধ্বনি :- ই এবং উ স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময় মুখবিবরের মধ্যে জিহ্বার অবস্থান হয় সব থেকে উচ্চে , তাই এর এমন নাম ।

ঘ) নিম্ন স্বরধ্বনি :- আ – ধ্বনিটি উচ্চারণের সময় জিহ্বার অবস্থান হয় সব থেকে নিম্নে , তাই এর এমন নাম ।

ঙ) উচ্চ-মধ্য স্বরধ্বনি :- এ, ও – স্বরধ্বনিদ্বয় উচ্চারণের সময় মুখবিবরের মধ্যে জিহ্বার অবস্থান উপরের দিকে হলেও সর্বাধিক উচ্চতায় থাকে না , তাই এর এমন নাম ।

চ) নিম্ন-মধ্য স্বরধ্বনি – অ, অ্যা – স্বরধ্বনিদ্বয় উচ্চারণের সময় মুখবিবরের মধ্যে জিহ্বার অবস্থান নিচের দিকে হলেও সর্বাধিক নিম্নে থাকে না , তাই এর এমন নাম ।

ছ) কেন্দ্রীয় স্বরধ্বনি :- আ – ধ্বনিটি সম্মুখ ও পশ্চাৎ স্বরধ্বনির মধ্যে অবস্থিত বলে এর এমন নাম ।

৫) মুখবিবরের অবস্থান অনুযায়ী মৌলিক স্বরধ্বনির শ্রেণীবিভাগ –
উঃ- মুখবিবরের অবস্থান অনুযায়ী মৌলিক স্বরধ্বনিকে সাত ভাগে ভাগ করা হয় । যেমন –

ক) প্রসারিত স্বরধ্বনি :- ই, এ, আ, অ্যা – এই চারটি স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময় ওষ্ঠ ও অধর কম-বেশী প্রসারিত থাকে , তাই এর এমন নাম ।

খ) কুঞ্চিত স্বরধ্বনি :- অ, ও, উ – এই তিনটি উচ্চারণের সময় ওষ্ঠার ক্রমশ কুঞ্চিত হতে থাকে , তাই এর এমন নাম ।

গ) সংবৃত স্বরধ্বনি :- ই এবং উ – এই দুই স্বরধ্বনি উচ্চারণকালে মুখবিবর সর্বাধিক সংবৃত থাকে , তাই এর এমন নাম ।

ঘ) অর্ধসংবৃত স্বরধ্বনি :- এ এবং ও – ধ্বনি দুটি উচ্চারণের সময় মুখবিবর আংশিক সংবৃত থাকে , তাই এর এমন নাম ।

ঙ) বিবৃত স্বরধ্বনি :- আ – ধ্বনিটি উচ্চারণের সময় মুখবিবর এবং ওষ্ঠাধর সর্বাধিক বিবৃত হয় বলে , এর এমন নাম হয়েছে ।

চ) অর্ধবিবৃত স্বরধ্বনি :- অ এবং অ্যা – ধ্বনি দুটি উচ্চারণের সময় মুখবিবর আংশিক বিবৃত হলেও সর্বাধিক বিবৃত হয় না , তাই এর এমন নাম ।

ছ) কেন্দ্রীয় স্বরধ্বনি :- আ – ধ্বনিটি প্রসারিত ও কুঞ্চিত স্বরধ্বনির মাঝখানে অবস্থিত বলে , এর এমন নাম করা হয়েছে । 

আমাদের ব্যাকরণ প্লে লিস্ট দেখুন। ধ্বনি ভাষার ভিত্তি আলোচনা সম্পর্কে মতামত জানান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *