শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় – সংক্ষিপ্ত জীবন কথা
শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। তাঁর রচনায় আছে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবনের কথা। অতি সাধারণ জীবনকথা তাঁর লেখনী স্পর্শে হয়ে উঠেছে অসাধারণ। এই প্রচ্ছদে সেই মহান শিল্পী সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।
জন্ম ও শিক্ষা
কল্লোল যুগের অন্যতম সাহিত্যক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় -এর জন্ম ১৩০৫ সালের ৫ ই চৈত্র (১৯০১ এর ১৮ ই মার্চ) বীরভূম জেলার রূপসীপুরের হাটসেরান্দি গ্রামে। বাবা ধরণীধর মুখোপাধ্যায় , মাতা হেমবরণী দেবী। মাত্র ২ বছর বয়সে মাকে হারিয়েছিলেন। মামার বাড়ি বর্ধমান জেলার অণ্ডালে । দাদামশাই ছিলেন ধনী কয়লাখনি ব্যবসায়ী রায়সাহেব মৃত্যুঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়।
বাবা ধরণীধর মুখোপাধ্যায় ছিলেন আপনভোলা শিল্পী মানুষ।খুব সুন্দর ছবি আঁকতেন ও মাটির কাজ করতেন। সাপ ধরা এবং ম্যাজিক দেখানো ছিল তাঁর অন্যতম কাজ। বাবার শিল্পীসত্তা শৈলজানন্দের চরিত্র ও মননে গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল।
মাইনর স্কুলে পড়া শেষ করে তিনি হাইস্কুলে পড়ার জন্য রানীগঞ্জে আসেন। সেখানে কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। পাশাপাশি দুই স্কুলে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুত্ব তৈরি হয়। টেস্ট পরীক্ষার সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতে দুই বন্ধু আসানসোল থেকে পালিয়ে আসেন এবং সেখান থেকে এস ডি ও এর চিঠি নিয়ে কলকাতা চলে যান সেনাবাহিনীতে যোগদানের উদ্দেশ্যে। নজরুলের চাকরি হলেও মামার কারসাজিতে সামান্য অজুহাতে শৈলজানন্দের চাকরি বাতিল হয়ে যায়।মামা কলকাতা থেকে তাঁকে নিয়ে যান বাড়িতে।
নাকোড়বান্দা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাশ করে কলকাতায় আসেন ও কলেজে ভর্তি হন।কিন্তু অর্থাভাবে কলেজ ছাড়তে বাধ্য হন।তারপর ভর্তি হন বাগবাজার কাশিমবাজার পলিটেকনিক স্কুলে। সেখানে তিনি টাইপ রাইটিং শিখতেন।
কর্ম ও সাহিত্য
কলকাতায় চাকরির সুবিধা না করতে পেরে কুমারডুবির কয়লাখনিতে চাকরি নিলেন।কুমারডুবির মেসে থাকতেন। বাল্যকাল থেকে সাহিত্য অনুরাগী ছিলেন।“বাঁশরি” পত্রিকায় প্রকাশিত হল তাঁর রচিত “আত্মঘাতীর ডাইরি”। রচনা সূত্রে ধনী দাদামশাই এর সাথে মনোমালিন্য হল, তাঁর আশ্রয় থেকে বিদায় দিলেন।
বর্ধমান জেলার ইকড়ার জমিদার করালীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে লীলাবতীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এই সময় জোড়জানকি কয়লাখনিতে কাজ নিয়ে দেখলেন কয়লাখনির শোষিত , নিপীড়িত কুলিমজুরদের। চাকরি ছেড়ে দিলেন। দারিদ্র ঘিরে ধরল। কলকাতার ভাবানীপুরে একটি পানের দোকান করলেন। তাও রইল নিল, চলে গেলেন রূপসীপুরে। সেই সময় দাদামশাই মারা গেলেন। দিদিমা শৈলজানন্দকে নিয়ে চলে গেলেন কাশী। সেখানে “অ্যাংলো বেঙ্গলি স্কুলে” বাংলার শিক্ষক হিসাবে যোগ দিলেন। কাশি থেকে ফিরে কালীঘাটে থাকতে আরম্ভ করেন। সাহিত্যকে পুরদস্তুর জীবিকা হিসাবে গ্রহণ করেন।
সাঁওতাল, বাউরি প্রভৃতি অবহেলিত শ্রেণির মানুষদের জীবন নিয়ে তিনি একের পর এক গল্প লিখে চললেন। মাসিক “বসুমতি“ পত্রিকায় প্রকাশিত হল তার প্রথম গল্প “কয়লাকুঠীর দেশ”। ‘কল্লোল’ পত্রিকায় ১ ম বর্ষ ১ ম সংখায় প্রকাশিত হল প্রথম “মা”। ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হল রেজিং রিপোর্ট বলিদান প্রভৃতি।
নিজের সাহিত্য রচনার উৎস নির্ণয়ে বলেছেন –
বীরভূমে , সাঁওতাল পরগণায় দেখছি সাঁওতাল পুরুষরা সৎ, চরিত্রবাণ , দূর্জয় সাহসের অধিকারী। সত্যবাদী জিতেন্দ্রিয়। সাঁওতাল মেয়েদের দেহে পরিপূর্ণ যৌবন,ওরা সতী। রানীগঞ্জের কয়াকুঠিতে দেখলাম অনুরূপ পরিবেশ বদলে যাওযায় তারা মিথ্যাবাদী, অসৎ, শঠ , চোর । তাদের এই পরিবর্তন আমার মনকে পীড়া দিয়েছে। সেই রূপেই রূপায়িত করলাম আমার সাহিত্য।
সেই সময় বিখ্যাত সব পত্রিকা ভারতবর্ষ, প্রবাসী, বিচিত্রা , মাসিক বসুমতী, কল্লল, কালিকলম, বঙ্গবাণী, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা , সংহতি , ছায়া, সাহানা প্রভৃতিতে একের পর এক গল্প প্রকাশিত হতে থাকে । সম্পাদনা করেছেন সাপ্তাহিক সাহানা পত্রিকা , গল্পভারতী।
চলচ্চিত্র ও নাটক
চলচিত্রের প্রতি আকৃষ্ট হন।চিত্রনাট্য রচনা করতে থাকেন । চিত্রনাট্য রচনা করতে থাকেন , সেই সঙ্গে শিখতে থাকেন চলচ্চিত্রের টেকনিক, ফটগ্রাফী ইত্যাদি।তাঁর প্রথম পরিচালিত ছবি “নন্দিনী “। বন্ধু নজরুল ইসলাম এই সিনেমার একাধিক গান লিখে দিয়েছিলেন। ছবিটি দারুণ জনপ্রিয় হয়।
এরপর তাঁর অসাধারণ ছবি “বন্দি”। তারপর একে একে শহর থেকে দূরে, অভিনয় নয় , মানে না মানা, শ্রীদূর্গা , রায়চৌধূরী , ঘুমিয়ে আছে গ্রাম , রং বেরং, সন্ধ্যবেলার রূপকথা, বসাইন্ড লেন ,মনি ও মানিক , বাংলার নারী , কথা কও , আমি বড় হব ইত্যাদি ছবি করেছেন।
ছবি তৈরির জগত থেকে আবার সাহিত্য জগতে ফিরে এলেন। যোগ দিলেন কলকাতার বেতার কেন্দ্রের নাট্য বিভাগে। আকাশবাণীতে থাকার সময় শৈলজানন্দ বহু নাটক প্রযোজনা ও পরিচালনা করেন।।যেমন – গ্রহচক্র, কবি, কালরাত্রি, নারায়ণী , রাহু, নিরুদ্দেশ প্রভৃতি ।
পুরস্কার
সাহিত্য সেবার স্বীকৃত হিসাবে পেয়েছেন “আনন্দ পুরষ্কার “(১৯৬০) , উল্টোরথ (১৯৬৬)। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৬৮) এবং বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় তিঁকে ডিলিট উপাধি দেন । মরণোওর শরৎ প্রদান করা হয় ১৯৭৬ সালে ।
শেষ কথা
১৯৭২ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন ।১৯৭৬ সালের ২ জানুয়ারি শুক্রবার বেলা ১ টা ৩০ মিনিতে পরলোক গমন করেন। “কয়লাকুঠির দেশ “ গল্পটি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় -এর উদ্দেশ্যে যা বলেছিলেন সেটা বোধহয় তাঁর সমগ্র সাহিত্য জীবন সম্বন্ধ সবচেয়ে গভীর অনুভাবী মন্তব্য –
“আমরা দোতলার জানালা দিয়ে গরীবদের দেখছি , তুমি তাদের সঙ্গে মিলে মিশে একাত্ম হয়ে তাদের সুখ দূঃখ, আনুভব করেছ গভীরভাবে। তোমার লেখা আমার ভালো লাগে। সাহিত্য তোমায় স্থায়ী আসন দেবে।“
thank You so much
thanks for your feedback