অন্যান্য সাহিত্যিক

গোপাল হালদার – একটি বিরল আলোচনা

১৯০২ খ্রীস্টাব্দের ১১ ই ফেব্রুয়ারী (১৩০৮ বঙ্গাব্দের ২৮ শে মাঘ) ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগনার বিদগাঁও গ্রামে গোপাল হালদার  জন্মগ্রহণ করেন। পিতা – সীতাকান্ত হালদার ও মাতা – বিধুমুখী দেবী। এঁদের চার কন্যা ও তিন পুত্রের মধ্যে গোপালবাবু ছিলেন দ্বিতীয় সন্তান ।

শিক্ষাজীবন

গোপাল হালদার এর পিতা ছিলেন একজন আইনজীবি , তাই তাঁর কর্মস্থল ছিল নোয়াখালী। সেই সূত্রেই গোপালবাবুর শিক্ষা শুরু হয় সেখানে থেকেই । প্রথমে ১৯০৮-এ বাড়ির কাছে বঙ্গ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন । ১৯১৮-তে আর. কে. জুবিলি স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কলিকাতা স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আই. এ. এবং ইংরেজীতে সাম্মানিক বিভাগে স্নাতক হন।

১৯২০-তে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজী সাহিত্যে দ্বিতীয় শ্রেণীতে এম. এ. পাশ এবং ১৯২৫ খ্রীস্টাব্দে আইন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সম্মানজনক ‘ ট্র্যাগোর-ল অ্যাওয়ার্ড ‘ লাভ করেন। শেষে, বি. সি. এস. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও স্বাস্থ্যের কারণে বাতিল হয়ে যান ।

গোপাল হালদার – কর্মজীবন

গোপাল হালদার এর কর্মজীবন পিতার মতোই ওকালতি দিয়ে শুরু হয়। এরপরে, বিচিত্র ও ব্যস্তজীবন শুরু হয় তাঁর। ১৯২৬-এ ‘প্রবাসী’র অন্তর্গত কলকাতার ইংরাজী সাপ্তাহিক ‘উয়েলফেয়ার’ এ সহ সম্পাদকের পদে যোগদান করেন , ১৯২৯-৩০ এ ফেণী কলেজে অধ্যাপনা , ১৯৩০-৩২ এ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ত্ব বিভাগে রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট , ১৯৩৮-এ ‘ প্রবাসী ‘ ও ‘ মডার্ণ রিভিউ ‘ পত্রিকায় সম্পাদকীয় দপ্তরে কর্মগ্রহণ, ১৯৩৯-এ সুভাষচন্দ্র বসুর সহকারী হিসেবে সাপ্তাহিক ‘ ফরওয়ার্ড ব্লক ‘ পত্রিকার সম্পাদনার কর্মে নিযুক্ত হন।

১৯৪৪-এ বীরেন্দ্রনাথ রায় ও রবীন্দ্র মজুমদারের সঙ্গে ‘ পরিচয় ‘ পত্রিকার সম্পাদনা দায়িত্ব পালন করেন । ১৯৫২-৬৭ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত ‘ পরিচয় ‘ এর দ্বিতীয়বার সম্পাদক পদ গ্রহণ করেন , আবার এই সময়ই কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট – সিন্ডিকেটের সদস্য হয়ে কাজ করেন । ১৯৫২-তে গৌহাটি ও এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রিত হয়ে সভা ও সংস্কৃতি বিষয়ে বক্তৃতা প্রদান করেন । ১৯৫৫-তে নিখিল ভারত বঙ্গসাহিত্য সম্মেলনে লক্ষ্ণৌ অধিবেশনে সভাপতি হোন , ১৯৫৭-তে রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট কনস্টিট্যুয়েন্সি থেকে সর্বোচ্চ ভোটে পশ্চিমবঙ্গ বিধান পরিষদে নির্বাচিত হন।

১৯৬০-এ মস্কোতে অনুষ্ঠিত ‘ ওরিয়েন্টাল কনফারেন্স ‘ এ আমন্ত্রিত সদস্য হিসেবে যোগদান করেন । এইভাবে তিনি নানাধিক গুরুত্বপূর্ণ কর্মের মধ্যে দিয়ে নিজের জীবনের প্রতিটি মূহুর্তকে ব্যস্তভাবে সাজিয়ে রেখেছেন ।

গোপাল হালদার – রচনাসমূহ

ক) প্রবন্ধগ্রন্থ :- সংস্কৃতির রূপান্তর (১৯৪১), বাঙালী সংস্কৃতিল রূপ (১৯৪৭), এ যুগের যুদ্ধ (১৯৪২), বাঙালী সংস্কৃতি প্রসঙ্গ (১৯৫৬), ভারতের ভাষা (১৯৬৭), বাণিজ্য জিজ্ঞাসা (১৯৬৯), বাঙালীর আশা বাঙালীর ভাষা (১৯৭২) – ইত্যাদি ।

খ) বাংলা সাহিত্যে রূপরেখা (১৯৫৩,১৯৫৮), বাংলা সাহিত্য পরিক্রমা (১৯৫৯), ইংরেজী সাহিত্য রূপরেখা (১৯৬১), রুশ সাহিতযের রূপরেখা (১৯৬৬), কাজী নজরুল ইসলাম (১৯৬২), সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১৯৬২) ।

গ) আত্মজীবনী :- রূপনারায়নের কূলে (১৯৬৯, ১৯৭৮)।

ঘ) পত্র-পত্রিকা সম্পাদনা :- সোভিয়েট দেশ (১৯৪১), সীতারাম (১৯৫০), বঙ্কিমচন্দ্রের বিষবৃক্ষ (১৯৫০), রবীন্দ্রনাথ (১৯৬১), দূরসুদূর (১৯৬৬), বঙ্কিম রচনা সমগ্র (১৯৭৪), দীনবন্ধু রচনা সমগ্র (১৯৭৩) – ইত্যাদি ।

আরও দেখুন

ঙ) উপন্যাস :- একদা (১৯৩৯), পঞ্চাশের পথ (১৯৪৪), তেরশ পঞ্চাশ (১৯৪৫), ঊনপঞ্চাশী (১৯৪৬), ভাঙন (১৯৪৭), উজানগঙ্গা (১৯৫০), অন্যদিন (১৯৫০), স্রোতের দীপ (১৯৫০), আর একদিন (১৯৫১), ভূমিকা (১৯৫২), নবগঙ্গা (১৯৫৩), জোয়ারের বেলা (১৯৫৪), ভাঙনী কূল (১৯৬৬), ত্রিদিবা (১৯৭৮) ।

চ) ছোটগল্প :- ধূলিকণা (১৯৪৮) ।

ছ) রম্যরচনা :- বাজে লেখা (১৯৪২), আড্ডা (১৯৫৬), বনচাঁড়ালের কড়চা (১৯৬০), স্বপ্ন ও সত্য (১৯৫১) ।

ছদ্মনাম  – অমৃতকণ্ঠ চট্টোপাধ্যায় , শ্রীকশ্যপ ‘ শেষ মহসঙ্গীতি’ , প্রফুল্ল হালদার ইত্যাদি ।

শেষ কথা

প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য সমালোচনায় গোপালবাবুর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় যায় । একজন মার্কসবাদী পন্ডিত হয়েও তিনি বেস-সুপার স্ট্রাকচারের সীদ্ধ ধারনার অনুবর্তন না করে সাহিত্যের ইতিহাসে যুগবিভাগ করেন। এনার দৃষ্টিভঙ্গির বিশেষত্ব ছিল, তিনি সাহিত্য সমাজ পরিপ্রেক্ষিতের গুরুত্বকে যেমন অপরিহার্য বলে দেখান , তেমনি সাহিত্য যে মূলত ব্যক্তির সৃষ্টি – এই সত্যও স্মরণে রেখেছেন ।  আধুনিক সাহিত্য সম্পর্কেও তাঁর বিশ্লেষণ সংক্ষিপ্ত , কিন্তু প্রাঞ্জল।

বুদ্ধীদীপ্ত ব্যঙ্গে শালীনতা বজায় রেখে তিনি আপন মনে নিজের বক্তব্য প্রকাশ করে গেছেন। গোপাল বাবুর সমালোচনা রীতির মধ্যে অতিবাদিতা নেই । বাচনরীতি মাঝে মাঝে ঋজু ও সংক্ষিপ্ত । কিন্তু এর মধ্যে ব্যতিক্রমও লক্ষ্য করা গেছে , কোথাও কোথাও গভীর বক্তব্যও উপস্থাপিত রয়েছে । যেমন – বিষ্ণু দে-র ‘অন্বিষ্ট’ কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে গোপালবাবুর অভিমত – ” বিষ্ণু দে স্বকীয় সাধনায় অনলস যদিও তিনি কখনও সাধারণ পাঠকের নিকট সহজবোধ্য হবেন না , ‘অন্বিষ্ট’ও তা হয়নি”। তাই বলব গোপাল হালদারের মতো মুক্তমতি প্রাবন্ধিক ব্যক্তিত্ব বাংলা সাহিত্যে বিরল বললেই চলে ।

সর্বশেষ সংশোধিত – ১০.১১.২০২৪

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *