বৈষ্ণব পদসংকলন গ্রন্থ – খুঁটিনাটি তথ্য
প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের একটি বিশেষ আলোচ্য ক্ষেত্র হল বৈষ্ণব পদাবলি। শ্রীচৈতন্যদেব ও তাঁর দিব্যরূপকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পদকর্তা রচনা করেছেন নানা পদ। আর সেই সমস্ত রচিত পদগুলি নানা সময় নানা গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। আমাদের আজকের আলচনায় পাঠক পাঠিকা পাবেন সেই সমস্ত সংকলন গ্রন্থের পরিচয় – বৈষ্ণব পদসংকলন গ্রন্থ । এই আলোচনায় সংকলন গ্রন্থের নাম, সংকলকের নামসহ নানা তথ্য পাবেন। মতামত জানাতে পারেন কমেন্ট করে।
বৈষ্ণব পদ-সঙ্কলন গ্রন্থ তালিকা
১. কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়
সংকলক – দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে পাল রাজাদের আমলে সংকলিত গ্রন্থটির সংকলক বিদ্যাধর। সংকলন গ্রন্থটির পূর্বনাম ‘সুভাষিতরত্নকোষ’। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ‘কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়’ নামকরণ করেন। F.W.Tomas ১৯১২ খ্রিঃ ‘কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়’ এর পুঁথি সম্পাদনা করেন। তিনিই গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। গ্রন্থটিতে ১১১ জন কবির ৫২৫টি শ্লোক আছে।
২. সদুক্তিকর্ণামৃত
গ্রন্থটির সংকলক হলেন লক্ষ্মণ সেনের মহাসামন্ত বটুক দাসের পুত্র শ্রীধর দাস। গ্রন্থটি সংস্কৃতে রচিত। ১২০৬ খ্রিঃ সেন যুগে এটি সংকলিত হয়। এতে ৪৮৫ জন কবির ২৩৭০ টি শ্লোক সংকলিত আছে।
৩. ক্ষণদাগীতচিন্তামণী
এই সংকলন গ্রন্থটি বৈষ্ণবপদ সংকলনের আদি গ্রন্থ। সপ্তদশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বৈষ্ণব দার্শনিক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী বৃন্দাবনে বাসকালে এই সংকলন-গ্রন্থ প্রস্তুত করেন। ক্ষণদার অর্থ ‘রাত্রি’। এই গ্রন্থটি ৩০ টি ক্ষণদা বা রাত্রিতে বিভক্ত। গ্রন্থটিতে ৪৫ জন কবির ৩০০ এর অধিক পদ সংকলিত হয়েছে। বিশ্বনাথ কবি রাজবল্লভ ও হরিবল্লভ ভণিতা ব্যবহার করে নিজস্ব ৪০ টি ব্রজবুলিতে রচিত পদ এই গ্রন্থে রেখেছেন।
৪. গীতচন্দ্রোদয়
নরহরি চক্রবর্তীর ‘গীতচন্দ্রোদয়’ ও ‘গৌরচরিত্রচিন্তামণি’ – ‘গীতচন্দ্রোদয়’ সংকলন গ্রন্থটি নবদ্বীপের হরিবোলা কুটীরের পূজ্যপাদ্য হরিদাস দাস ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশ করেন। এতে মোট ১১৭১ টি পদ আছে। ‘গৌরচরিত্রচিন্তামণি’ ও হরিদাস দাস কর্তৃক ১৯৪৭ খ্রিঃ প্রকাশিত হয়েছিল। এতে গৌরাঙ্গবিষয়ক পদ সংগৃহীত হয়েছিল। পদ সংখ্যা ৩৭১টি।
৫. পদামৃতসমুদ্র
রাধামোহন ঠাকুরের ‘পদামৃতসমুদ্র’ – শ্রীনিবাস আচার্যের প্রপৌত্র রাধামোহন ঠাকুর অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ‘পদামৃতসমুদ্র’ শীর্ষক পদসংকলন গ্রন্থটি প্রস্তুত করেন। এই গ্রন্থে মোট পদ সংখ্যা ৭৪৬টি। তার মধ্যে রাধামোহনের ২৩৮টি পদ এই গ্রন্থে আছে।
পদকল্পতরু
বৈষ্ণবদাসের ‘পদকল্পতরু’ – বৈষ্ণব পদের সর্ববৃহৎ ও সর্বশ্রষ্ঠ সংকলন ‘পদকল্পতরু’ সমগ্র ভারতীয় সাহাত্যের এক অভিনব সংগ্রহ। এটির সংকলক বৈষ্ণবদাসের প্রকৃত নাম গোকুলানন্দ সেন। প্রথমে গ্রন্থটির নাম ছিল ‘গীতকল্পতরু’। এতে ১৪০ জন পদকর্তার ৩০০০ এর অধিক পদ সংগৃহীত হয়েছে। গ্রন্থটিতে বিভিন্ন কবির পদ সংখ্যা হল –
বিদ্যাপতি – ১৬৩টি
চণ্ডীদাস – ১১৮টি
গোবিন্দদাস কবিরাজ – ৪০৬টি
জ্ঞানদাস – ১৮৬টি
বলরামদাস – ১৩৬টি
দীনবন্ধু দাস – ৯৯টি
রাধামোহন ঠাকুর – ১৮২টি
গোকুলানন্দ সেন – ২৬টি
এই বৃহৎ সংকলনে সংকলক নিজের মাত্র ২৬টি পদ রেখে বৈষ্ণবীয় বিনয়ের পরিচয় দিয়েছেন।
অন্যান্য সংকলন গ্রন্থ
উপরোক্ত সংকলন গ্রন্থগুলি ছাড়াও আরো অনেক গ্রন্থ আছে যা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। যেমন – গৌরসুন্দর দাসের ‘কীর্তনানন্দ’ (সঙ্কীর্তনানন্দ) যাতে ৬০ জন কবির প্রায় প্রায় ৬৫০টি পদ বিদ্যমান। মুর্শিদাবাদ থেকে বনোয়ারীলাল গোস্বামী এটি প্রকাশ করেন।
এছাড়া দীনবন্ধু দাসের ‘সঙ্কীর্তনামৃত’। কমলাকান্ত দাসের ‘পদরত্নাকর’ (১৮০৬-১৮০৭ খ্রি), নিমানন্দ দাসের ‘পদরসসার’, গৌরমোহন দাসের ‘পদকল্পলতিকা’, অক্ষয়চন্দ্র সরকারের প্রাচীন ‘কবিতাসংগ্রহ’ (১২৮৫ বঙ্গাব্দ), জগবন্ধু ভদ্রের ‘গৌরপদতরঙ্গিনী’ (এতে প্রায় ১৫০০ গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ সংকলিত আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘পদরত্নাবলী’, মনোহর দাসের ‘পদসমুদ্র’ নামক একটি সংকলন গ্রন্থের কথা শোনা যায় যাতে নাকি প্রায় ১৫০০০ (!!) পদ সংকলিত। তবে গ্রন্থটি পাওয়া যায়নি। সতীশচন্দ্র রায়ের ‘অপ্রকাশিত পদরত্নাবলী’, রামগোপাল দাস বা গোপাল দাসের ‘শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণরসকল্পবল্লী’, পীতাম্বর দাসের ‘রসমঞ্জরী’, মুকুন্দদাসের ‘সিদ্ধান্তচন্দ্রোদয়’ এবং চন্দ্রশেখর ও শশিশেখরের ‘নায়িকারত্নমালা’।