বৈষ্ণব পদাবলি

চণ্ডীদাস – বাঙালির প্রাণের কবি

চণ্ডীদাস  বাঙালির প্রাণের কবি। তিনি সম্ভবত বীরভূমের নান্নুরে ১৪১৭ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। চৈতন্যদেব তাঁর পদাবলির রস গ্রহণ করে খুব আনন্দ লাভ করতেন। চণ্ডীদাস নামে একাধিক কবির অস্তিত্ব বাংলা সাহিত্যে আজও এক জিজ্ঞাসার চিহ্ন। নানা পণ্ডিতের মতের যোগবিয়োগ করে একটা সীদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, আমরা বাংলা সাহিত্যে তিন ধরনের চণ্ডীদাসকে পাই। যথা – চৈতন্যপূর্ববর্তী কবি ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ রচয়িতা বড়ু চণ্ডীদাস, চৈতন্যপরবর্তী কবি পদাবলীর চণ্ডীদাস বা দ্বিজ চণ্ডীদাস এবং দীন চণ্ডীদাস।

চণ্ডীদাস কথা

বৈষ্ণব পদাবলিতে যে চণ্ডীদাসের বিভিন্ন পদ আছে, তিনি হলেন পদাবলীর চণ্ডীদাস। তাঁর জীবনকথা নানা কিংবদন্তী ও গালগপ্পে পরিপূর্ণ। ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তার “বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত” নামক গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে নানা কাহিনির উল্লেখ করেছেন, যার একটি তুলে ধরা হল –

“নান্নুর গ্রামে চণ্ডীদাসের জন্ম । তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতার নাম নকুল। নকুল সমাজে বেশ মান্যগন্য ছিলেন। চণ্ডীদাস শাক্ত দেবী বাশুলীর সেবক হইলেও বৈষ্ণব সহজিয়া মতের উপাসক ছিলেন এবং রামীকে সহজিয়া প্রেমতত্ত্বের যথার্থ সাধিকা জানিয়া তাহার প্রেমে উন্মাদ হইয়া পড়েন । … ইত্যাদি ।”

ধারণা করা হয়, তাঁর আসল নাম ছিল অনন্ত এবং কৌলিক উপাধি বড়ু, গুরুপ্রদত্ত নাম চণ্ডীদাস। এই নামে একাধিক কবির নাম পাওয়া যায়। বড়ু চণ্ডীদাস, দ্বিজ চণ্ডীদাস, দীন চণ্ডীদাস ও চন্ডীদাস। তবে বিভিন্ন গবেষকদের মতে বড়ু চণ্ডীদাস শ্রীকৃষ্ণচরিতের রচয়িতা।

১৩১৬ বঙ্গাব্দে (১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দ) বসন্তরঞ্জন রায় বাঁকুড়া জেলা থেকে বড়ু চণ্ডীদাসের ভণিতায় একটি পুঁথি আবিষ্কার করেন। বাংলা সাহিত্যে এই গ্রন্থটিই শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নামে খ্যাত। উল্লেখ্য, এই গ্রন্থটি বন-বিষ্ণুপুরের নিকটবর্তী কাঁকিল্যা নিবাসী দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের কাছে ছিল। এই গ্রন্থটি ১৩২৩ বঙ্গাব্দে কলকাতা বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত হয়। পুঁথিটির মাঝখানের এবং শেষের কয়েকটি পত্র না থাকায় এর নাম জানা যায়নি। তাই এর বিষয়বস্তু কৃষ্ণলীলা বিষয়ক বলে নাম রাখা হয়েছে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’। ১৩২৩ বঙ্গাব্দে (১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে) এই নামে বসন্তরঞ্জনের সম্পাদনায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে পুঁথিটি মুদ্রিত হলে গবেষক মহলে আলোড়নের সৃষ্টি হয় এবং বাংলা ভাষার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে গবেষণার নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়। পুঁথিটি থেকে বাংলা লিপির বিবর্তন সম্পর্কেও অনেক ধারণা পাওয়া যায়।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন 

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ও চণ্ডীদাস

বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন একটি গীতি-আলেখ্য। রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলা এর বিষয়বস্তু। মোট ১৩ খন্ডে ৪১৮টি পদে এটি বিন্যস্ত। খণ্ডগুলি হল জন্মখণ্ড, তাম্বূল খণ্ড, দানখখণ্ড, নৌকাখণ্ড, ভারখণ্ড, ছত্রখণ্ড, বৃন্দাবন খণ্ড, কালীয়দমন খণ্ড, যমুনা খণ্ড, হারখণ্ড, বাণখণ্ড, বংশীখণ্ড ও রাধাবিরহ। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মূল কাহিনি ভাগবত থেকে নেওয়া হলেও এতে বিভিন্ন পুরাণ এবং জয়দেবের গীতগোবিন্দের প্রভাব রয়েছে। কাব্যের প্রধান চরিত্র তিনটি – কৃষ্ণ, রাধা ও বড়াই (দূতী) এবং চরিত্র-মধ্যে ঘাত-প্রতিঘাত আছে। বাক-বিতন্ডা, রাগ-দ্বেষ ইত্যাদিও আছে। ফলে কাব্যটি গতিশীল ও নাট্যরসাশ্রিত হয়েছে। এই কাব্যে গীতিরসের উপস্থিতি লক্ষণীয়। কাব্যটি শৃঙ্গাররসপ্রধান এবং ঝুমুর গানের লক্ষণাক্রান্ত। এটি পয়ার ও ত্রিপদী ছন্দে রচিত।

পদাবলির চণ্ডীদাস

চৈতন্য পূর্বযুগের বাংলার শ্রেষ্ঠ মরমী গীতিকবি হলেন এই পদাবলির চণ্ডীদাস। যাঁর পদ আস্বাদন করে স্বয়ং চৈতন্যদেবও মোহিত হয়েছেন। তিনি মনে করতেন মানুষের একমাত্র পরিচয় তাঁর মানবতায় –

“সবার উপরে মানুষ সত্য
তাহার উপরে নাই।”

এই চণ্ডীদাস প্রেমের কবি। তিনি তাঁর প্রায় সকল পদের মধ্যে রাধার বেদনাকেই ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। পূর্বরাগ, প্রেমবৈচিত্ত্য, আক্ষেপানুরাগ, নিবেদন প্রভৃতি পর্বে পদ রচনা করে সুখ্যাত হয়ে উঠেছেন। ওনার রচিত কিছু পদ –

ক) ‘সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম’ – (পূর্বরাগ)
খ) ‘যত নিবারিয়ে চাই , নিবার না যায় রে’ – (প্রেমবৈচিত্ত্য)
গ) ‘কি মোহিনী জান বধুঁ’ – (আক্ষেপানুরাগ)
ঘ) ‘বধুঁ কি আর বলিব আমি’ – (নিবেদন)।

আলোচক – সাহেব দাঁ ও কুতুব আলী 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Get Latest Updates For Free! Put Your Email Below.


This will close in 20 seconds