অন্যান্য সাহিত্যিক

অমিয় চক্রবর্তী – Amiya Chakrabartty

অমিয় চক্রবর্তী (Amiya Chakrabartty) শুধুমাত্র একজন কবি নন, তাঁর চরিত্রে নিহিত ছিল আরও নানা সত্তা। তাঁকে আমরা এক সাথে গীতিকার, সুরকার এবং শিক্ষাবিদ হিসেবে পাই।দেশ বিদেশের বহু স্থানে তিনি ভ্রমণ করেছেন। দেশের বাইরে অনেক স্থানেই তিনি ভারতীয় ধর্ম ও সাহিত্য নিয়ে নানা বক্তৃতা দিয়েছেন। আমাদের এই আলোচনায় কবি অমিয় চক্রবর্তী সম্পর্কে নানা তথ্য পাবেন পাঠক পাঠিকা।

Amiya Chakrabartty

কবি অমিয় চক্রবর্তীর জন্ম ১০ এপ্রিল, ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে।

বিদেশ যাত্রা প্রসঙ্গ

তিনি ছিলেন একজন বিশ্ব নাগরিক। পৃথিবীর নানা দেশে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন। কখনো জীবিকার তাগিদে, কখনো-বা নিছক পরিব্রাজক হিসেবে। ভ্রমণে আমৃত্যু ছিলেন অক্লান্ত। তাঁর বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রবীন্দ্র-ভক্ত এণ্ড্রুজের বন্ধু আলেকজাণ্ডার। তিনি অমিয় চক্রবর্তীকে বিলেতের বার্মিংহামের কলেজে আমন্ত্রণ জানালেন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে সেই কবির প্রথম বিদেশ যাত্রা। সেখানে প্রায় এক বৎসর ধরে ভারতবর্ষ ও আন্তর্জাতিকতা এবং ধর্ম বিষয়ে বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ হলো।

পরে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অধ্যয়ন ও গবেষণা করেছেন। অক্সফোর্ডের ব্রেজনোস্‌ কলেজে সিনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন ১৯৩৭ থেকে ১৯৪০ সাল অবধি। এ-সময় ব্যাপকভাবে ভারতবর্ষ-ইরান-আফগানিস্থান সফর করেছেন। রবীন্দ্রনাথের সহকারীরূপেও অনেক দেশে গিয়েছেন অমিয় চক্রবর্তী। প্রকৃতপক্ষে বিশ্ব-পরিব্রাজক রবীন্দ্রনাথের চেয়েও অনেক বেশী ভ্রমণ করেছেন তিনি। জার্মানি, ডেনমার্ক, রাশিয়া এবং আমেরিকা ভ্রমণ করেছেন রবীন্দ্রনাথের সহযাত্রী হিসেবে। পরে আরো দু’বার রাশিয়া ভ্রমণ করেছেন।

কবিতা

বাংলা কবিতায় আধুনিকতার পথিকৃত পঞ্চপাণ্ডবদের অন্যতম একজন অমিয় চক্রবর্তী । তাঁর প্রথম দিক কার কবিতায়  রবীন্দ্রনাথের প্রভাব থাকলেও তিনি অচিরেই স্বকীয়তা অর্জন করেন। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘খসড়া‘ প্রকাশের মধ্য দিয়ে তিনি জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে প্রমুখের সঙ্গে এক পংক্তিতে স্থান দখল করে নেন। এ সময় কবিতা পত্রিকায় বুদ্ধদেব বসু মন্তব্য করেন যে, “খসড়া প্রকাশের পর অমিয় চক্রবর্তীকে উল্লেখযোগ্য বাঙালি কবিদের অন্যতম বলে মেনে নিতে আমাদের দ্বিধা করা উচিৎ নয়।”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অমিয় চক্রবর্তীর কবিতার মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছিলেন “অনুভূতির বিচিত্র সূক্ষ্ম রহস্য”, বিশ্বসাহিত্যের স্পর্শ। সাহিত্যের ছাত্র ও অধ্যাপক, ধর্মতত্ত্ব-রাজনীতি, দশর্ন শাস্ত্রে সুপণ্ডিত, বিশ্বসাহিত্যের তন্নিষ্ঠ পাঠক অমিয় চক্রবর্তী ছিলেন মননঋদ্ধ মানুষ। তাঁর কবিতায় আবেগের সঙ্গে মিশে গেছে মননশীলতা। তাঁর কবিতায় প্রগাঢ় দার্শনিকতার মধ্যে অন্তর্লীন হয়ে আছে প্রবল সময় ও সমাজ-সচেতনতা। একটি কবিতায় তিনি লিখেছেন:

বাঙলার মেয়ে, এসে ছিল তার জীবনের দাবি নিয়ে,
দুদিনের দাবি ফলন্ত মাঠে, চলন্ত সংসারে;
কতটুকু ঘেরে কত দান ফিরে দিতে।
সামান্য কাজে আশ্চর্য খুশি ভরা।
আজ শহরের পথপাশে তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে কোথা
সভ্যতা ছোটে তেরোশো পঞ্চাশিকে।

ছন্দ, শব্দ চয়ন, শব্দ ব্যবহারের ধাঁচ, পংক্তি গঠনের কায়দা সবকিছু মিলিয়ে তিনি ছিলেন বাঙালী কবিদের মধ্যে অনন্যসাধারণ। কঠিন সংস্কৃত শব্দও তাঁর কবিতায় প্রবেশ করেছে অনায়াস অধিকারে। তাঁর কবিতায় জাগ্রত চৈতন্যের সঙ্গে সঙ্গে অবচেতনার প্রক্ষেপ পরিলক্ষিত হয়।

প্রবন্ধ-নিবন্ধ

অমিয় চক্রবর্তী যে সব পত্র-পত্রিকায় কম-বেশী নিয়মিত লিখেছেন তার মধ্যে রয়েছে কবিতা, বিচিত্রা, উত্তরসূরী, কবি ও কবিতা, পরিচয়, প্রবাসী প্রভৃতি। এর মধ্যে এক “কবিতা” পত্রিকাতেই অমিয় চক্রবর্তীর বেশ ক’টি গদ্য রচনা প্রকাশিত হয়েছিল – ‘এজরা পাউণ্ড: কবিতা’র দরবারে পত্রাঘাত’ (পৌষ ১৩৫৫), ‘এলিয়টের নতুন কবিতা’ (পৌষ ১৩৫০), ‘জয়েস প্রাসঙ্গিকী’ (কার্তিক, ১৩৪৮), ‘মার্কিন প্রবাসীর পত্র’ (পৌষ, ১৩৬০), ‘রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি’ (আশ্বিন, ১৩৪৮), ‘শেষের কবিতা’র লাবণ্য’ (আশ্বিন, ১৩৫৩) এবং ‘সমালোচকের জল্পনা’ (আশ্বিন, ১৩৫০)।

এছাড়া বুদ্ধদেব বসুর “নতুন পাতা” এবং সমর সেনের “গ্রহণ ও অন্যান্য কবিতা” গ্রন্থদ্বয়ের সমালোচনাও প্রকাশিত হয়েছিল (যথাক্রমে পৌষ ১৩৪৭ এবং কার্তিক ১৩৪৭ সংখ্যায়)। “কবিতা” পত্রিকায় চৈত্র ১৩৬২ সংখ্যায় বুদ্ধদেব বসুকে লেখা একটি খোলা চিঠি মুদ্রিত হয়েছিল ‘ছন্দ ও কবিতা’ এই শিরোনামে ।

আরো পড়ুন

দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকার জন্য অমিয় চক্রবর্তীর অনেক প্রবন্ধ-নিবন্ধ পত্রাকারে রচিত। এ-প্রকৃতির রচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘মার্কিন প্রবাসীর পত্র’ এবং ‘ছন্দ ও কবিতা’। এ-ছাড়া পত্রাকারে রচিত প্রবন্ধ-নিবন্ধের মধ্যে রয়েছে ‘ইয়োরোপে রবীন্দ্রনাথ’। শ্রীযুক্ত সোমনাথ মিত্রকে লেখা এ প্রবন্ধলিপিটি “প্রবাসী” পত্রিকার কার্তিক ১৩৩৭ সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল। “মস্কৌ-এর চিঠি’’ নামে দু’টি প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল বিচিত্রা পত্রিকার বাংলা ১৩৩৮ সনের যথাক্রমে মাঘ ও ফাল্গুন সংখ্যায়।

প্রবাসী পত্রিকায় আরো তিনটি পত্রাকার প্রবন্ধ-নিবন্ধ ছাপা হয়েছিল। যথা – ‘ফিনল্যান্ডের চিঠি’ (কার্তিক, ১৩৪৩ সংখ্যায) ‘প্যালেষ্টাইন প্রাসঙ্গিক’ (কার্তিক, ১৩৪৪ সংখ্যায়), ‘প্যালেষ্টাইনে হেরফের’ (অগ্রহায়ণ, ১৩৪৪)। এ-ছাড়াও তিনি ইংরেজিতে বেশ কিছু সংখ্যক সংখ্যক প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা করেছেন। এ-সকল প্রবন্ধ আন্তর্জাতিক মানের একাডেমিক জার্নাল সহ বিভিন্ন সংকলন-গ্রন্থে প্রকাশিত হয়।

প্রকাশিত গ্রন্থাবলী

খসড়া (১৯৩৮), একমুঠো (১৯৩৯), মাটির দেওয়াল (১৯৪২), অভিজ্ঞান বসন্ত (১৯৪৩), দূরযানী (১৯৪৪), পারাপার (১৯৫৩), পালাবদল (১৯৫৫), ঘরে ফেরার দিন (১৯৬১), হারানো অর্কিড (১৯৬৬), পুষ্পিত ইমেজ (১৯৬৭), অনিঃশেষ (১৯৭৬)

সম্মাননা

ইউনেস্কো পুরস্কার (১৯৬০), পদ্মভূষণ (১৯৭০), সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার, দেশিকোত্তম

আমাদের মক টেস্ট দিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *