সুধীন্দ্রনাথ দত্ত – জীবন ও সাহিত্য
কবি এবং সাহিত্যিক সুধীন্দ্রনাথ দত্ত আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম একজন কবি। তাঁর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘মননশীল তাঁর মন, তিনি মনন বিলাসী’। বাংলা ভাষার একজন প্রধান আধুনিক কবি। তাঁকে কেউ কেউ বাংলা কবিতায় “ধ্রুপদী রীতির প্রবর্তক” বলে থাকেন। আমাদের এই আলোচনায় আধুনিক কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পর্কে নানা তথ্য পরিবেশিত হয়েছে।
জীবনকথা
সুধীন্দ্রনাথ দত্তের জন্ম কলকাতার হাতিবাগানে ১৯০১ খ্রিঃ। তাঁর পিতা হীরেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন সেই সময়কার একজন বরেণ্য দার্শনিক। মাতা ইন্দুমতি বসুমল্লিক ছিলেন রাজা সুবোধচন্দ্র বসু মল্লিকের বোন। সুধীন্দ্রনাথের শৈশব কেটেছে কাশী তে। এখানেই তিনি থিয়সফিক্যাল হাই স্কুলে পড়াশোনা করেন। সময়কালটা ১৯১৪ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত । পরবর্তীকালে ১৯১৮ খ্রিঃ তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারি স্কুল থেকে এবং স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে স্নাতক হন। সেই সময়টা ১৯২২ খ্রিঃ। তিনি ইংরেজি সাহিত্য ও আইন বিভাগ নিয়েও পড়াশোনা করেছেন। দু বছর পড়াশোনা চালিয়ে গেলেও কোন বিষয়েই পরীক্ষা দেননি।
এরপর ১৯২৪ সালে ছবি বসুর সঙ্গে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, কিন্তু শীঘ্রই তাঁদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। পরে প্রায় কুড়ি বছর বাদে তিনি দ্বিতীয় বিবাহ করেন রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী রাজেশ্বরী বসুর সঙ্গে । পিতা হীরেন্দ্রনাথের ল ফার্মে কিছুদিন শিক্ষানবিশ হিসেবে জীবন কাটান। এরপর তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় ‘লাইট অব এশিয়া ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি’তে। ১৯২৯ খ্রিঃ তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ করেন। এরপর তিনি আরো বেশ কয়েকবার বিদেশ ভ্রমণ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪২ খ্রিঃ থেকে ১৯৪৫ খ্রিঃ পর্যন্ত তিনি এ.আর.পি’র দায়িত্ব পালন করেন। পরে ১৯৫৪ খ্রিঃ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং শেষ জীবন পর্যন্ত এই কাজেই যুক্ত ছিলেন। ১৯৬০ খ্রিঃ তিনি পরলোক গমন করেন।
সুধীন্দ্রনাথের ‘পরিচয়’
১৯৩১ সালে ‘পরিচয়’ পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন। ১৯৩১ খ্রিঃ থেকে ১৯৪৩ খ্রিঃ পর্যন্ত ১২ বছর তিনি এই পত্রিকার সম্পাদনা করে এসেছেন। এই পত্রিকাকে কেন্দ্র করে সেই সময় একটি সাহিত্যগোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল। যার অন্যতম ছিলেন কবি বিষ্ণু দে। অধ্যাপক ভূদেব চৌধুরী লিখেছেন –
…স্বীকার করতেই হয়, পত্রিকা হিসেবে সুধীন্দ্রনাথের ‘পরিচয়’ -এর শ্রেষ্ঠ দান বাংলা সাহিত্যে পুস্তক সমালোচনার এক অতি উন্নত – অভূতপূর্ব মান
সুধীন্দ্রনাথের এই পত্রিকাটির নামকরণ প্রখ্যাত মার্কসবাদী নীরেন্দ্রনাথ রায় দ্বারা পরিকল্পিত। পত্রিকার অধিকাংশ প্রাবন্ধিকও ছিলেন মার্কসবাদী। তাঁর এই পত্রিকা সম্পর্কে কেউ কেউ বলেছেন –
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত -এর ‘পরিচয়’ বাংলাদেশে মার্কসবাদের শিশু শয্যা ছিল।
সুধীন্দ্রনাথের ‘পরিচয়’ প্রকাশের প্রথম পাঁচ বছর ছিল ত্রৈমাসিক। পরে মাসিক পত্রিকা হিসেবে আরো সাত বছর প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকাকে কেন্দ্র করে তিনি সৃষ্টি করেছিলেন এক স্বতন্ত্র পথ। তিনি সেই ‘ধারার পথিকৃৎ নন কেবল, ব্যক্তিগত সৃষ্টির সামর্থ্যে সে ধারার শ্রেষ্ঠ প্রতিভূও” (অধ্যাপক ভূদেব চৌধুরী)
কাব্য পরিচিতি
১৯২৫ খ্রিঃ থেকে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত নানা পত্রিকায় লেখা আরম্ভ করেন। নিজের ‘পরিচয়’ সহ ‘কবিতা’ ও অন্যান্য পত্রিকায় তিনি লিখতে থাকেন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘তণ্বী’ ১৯৩০ খ্রিঃ প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় কাব্য হিসেবে প্রকাশিত হয় অর্কেষ্ট্রা (১৯৩৫)। এরপর একে একে প্রকাশিত হয় তাঁর ক্রন্দসী (১৯৩৭), উত্তর ফাল্গুনী (১৯৪০), সংবর্ত (১৯৫৩), দশমী (১৯৫৬) কাব্যগ্রন্থ। ফরাসি ও জার্মান কবিতার অনুবাদ করে একটি গ্রন্থও প্রকাশ করেন – ‘প্রতিধ্বনি’ (১৯৫৪)। প্রথম কাব্য ‘তণ্বী’তে দেশি বিদেশি নানা প্রভাব আছে সেকথা জানিয়েছেন কবি স্বয়ং। কাব্যের ভূমিকায় তিনি লিখছেন –
কবিতাগুলোর উপরে স্বদেশী বিদেশী অনেক কবিই ছায়াপাত করেছেন – সব সময়ে গ্রন্থকারের সম্মতিক্রমে নয়। কেবল রবীন্দ্রনাথের ঋণ সর্বত্রই জ্ঞানকৃত।
‘তণ্বী’ কাব্যগ্রন্থটিতে মোট ২৯টি কবিতা আছে। কাব্যের প্রথম কবিতার নাম ‘তণ্বী সে যে’ এবং শেষ কবিতার নাম ‘চিরন্তনী’। ‘অর্কেস্ট্রা’ মূলত প্রেমকাব্য। এই কাব্য থেকেই তাঁর বিশিষ্টতা। কাব্যটিতে মোট কবিতা আছে ২৫টি। কাব্যের প্রথম কবিতার নাম ‘হৈমন্তী’ এবং শেষ কবিতার নাম ‘অর্কেস্ট্রা’ । ‘ক্রন্দসী’ কাব্যটিতে মোট কবিতা আছে ২৪টি। ‘উত্তর ফাল্গুনী’ কাব্যটিতে মোট কবিতার পরিমাণ ১৯টি। কাব্যের প্রথম কবিতা ‘শর্বরী’ এবং শেষ কবিতা ‘প্রতিপদ’। ‘সংবর্ত’ কাব্যটিতে মোট কবিতা আছে ২৩টি। কাব্যের প্রথম কবিতার নাম ‘নান্দীমুখ’ এবং শেষ কবিতার নাম ‘পথ’। ‘দশমী’ কবির শেষ কাব্য। কাব্যের কবিতাগুলিতে মানবিক চেতনার বিকাশের কথা আছে। কাব্যটিতে মোট কবিতা আছে ১০টি। কাব্যের প্রথম কবিতার নাম ‘প্রতীক্ষা’ এবং শেষ কবিতার নাম ‘নষ্টনীড়’।
কাব্য ও কবিতা
তাঁর কবিতায় পুরাণের কল্পনা নানা রূপে দেখা দিয়েছে। কখনও ঈশ্বরের প্রতি আছে তাঁর তীব্র অবিশ্বাস কখনও সেই অবিশ্বাস রূপান্তরিত হয়েছে বিশ্বাসে। তাঁর কবিতায় যে কালচেতনা তাতে সমালোচকেরা গ্রীক ট্রাজেডির প্রভাব লক্ষ করেছেন। কোথাও কোন পৌরাণিক চরিত্র পরিণত হয়েছে তাঁর আত্মার প্রতিভূ হিসেবে। যেমন যযাতি। কবিতায় স্তরে স্তরে ফুটিয়ে তুলেছেন সমকালীন অবক্ষয়কে। ‘সংবর্ত’ কাব্যের ভূমিকায় তিনি জানিয়েছেন –
মালার্মে প্রবর্তিত কাব্যাদর্শই আমার অণ্বিষ্ঠ
মালার্মের অনুসরণেই তিনি তাঁর কাব্যে এনেছেন ‘নেতিবাদী জীবনদৃষ্টি, সংহত স্বল্পভাষ ও ব্যঞ্জনাময় প্রকাশশৈলী, শব্দের প্রচলিত আভিধানিক অর্থকে ভেঙে তাকে নূতন অর্থ প্রদান করা’ (ড. অশোককুমার মিশ্র)। তাঁর কবিতায় আছে প্রেম। সে প্রেমচেতনা প্রতিষ্ঠিত দেহানুভূতির উপর। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য তাঁর ‘অনুষঙ্গ’, ‘নাম’, ‘শাশ্বতী’ প্রভৃতি কবিতার নাম। তাঁর ‘শাশ্বতী’ (অর্কেষ্ট্রা) কবিতাটিকে অনেকেই কবির শ্রেষ্ঠ কবিতা বলে থাকেন।
রূপকের ব্যবহারও আছে সুধীন্দ্রনাথের কবিতায়। যেমন ‘উটপাখি’ কবিতাটি। উটপাখিকে এই কবিতায় নানা রূপকে চিত্রিত করেছেন কবি। উটপাখির প্রতীকে কবি সমকালীন ক্ষয়িষ্ণু মধ্যবিত্ত সমাজের কথা বলেছেন। কবির কথায় –
ফাটা ডিমে আর তা দিয়ে কি ফল পাবে ?
মনস্তাপেও লাগবে না ওতে জোড়া
অখিল ক্ষুধায় শেষে কি নিজেকে খাবে ?
কেবল শূন্যে চলবে না আগাগোড়া।
‘গদ্য ও পদ্যের ব্যবধান দূর করার মানসে তিনি সাধারণ মানুষের মুখের ভাষাকে কাব্যে স্থান দেননি। তিনি সর্বদা অবিকল শব্দপ্রয়োগের পক্ষপাতী। তাই অপ্রচলিত আভিধানিক শব্দের প্রতি তাঁর আকর্ষণ এত বেশী।’ (ড. বাসন্তীকুমার মুখোপাধ্যায়) সুধীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আধুনিক কবি ও সমালোচক বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন –
তাঁর বিষয়ে অনেকেই ব’লে থাকেন যে তিনি বাংলা কবিতায় ধ্রুপদী রীতির প্রবর্তক। এই কথার প্রতিবাদ ক’রে আমি এই মূহুর্তে বলতে চাই যে সুধীন্দ্রনাথ মর্মে মর্মে রোমান্টিক কবি, এবং একজন শ্রেষ্ঠ রোমান্টিক।
এককথায় সুধীন্দ্রনাথ দত্ত আধুনিক কবিদলেও সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তাঁর স্বাতন্ত্র্য তাঁর চিন্তায়, ভাবনায়, জীবন দর্শনে এবং কবিতার শব্দপ্রয়োগে তথা বাক্যগঠনে।