
চণ্ডীদাসের পদাবলী
আমরা এর আগে বিভিন্ন পর্যায় অনুসারে বিদ্যাপতির পদাবলী তুলে ধরেছি। আজকের আলোচনায় আমরা চণ্ডীদাসের পদাবলী থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদ তুলে ধরব। বৈষ্ণব পদকর্তা চণ্ডীদাস সম্পর্কে আমরা এর আগে আলোচনা করেছি। চণ্ডীদাস সমস্যা নিয়েও আমাদের আলোচনা আছে। আগ্রহী পাঠক পাঠিকা তা পড়ে দেখতে পারেন। আজকের এই পোস্টে আমরা বিভিন্ন পর্যায় অনুসারে চণ্ডীদাসের সম্পূর্ণ পদগুলি তুলে ধরেছি। আশা করি, পাঠক পাঠিকা তথা ছাত্রছাত্রীদের উপকারে লাগবে।
চণ্ডীদাসের পদাবলী – পূর্বরাগ পর্যায়
১
সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম।
কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো
আকুল করিল মোর প্রাণ।।
না জানি কতেক মধু শ্যাম নামে আছে গো
বদন ছাড়িতে নাহি পারে
জপিতে জপিতে নাম অবশ করিল গো
কেমনে পাইব সই তারে।।
নাম-পরতাপে যার ঐছন করল গো
অঙ্গের পরশে কিবা হয়।
যেখানে বসতি তার নয়নে দেখিয়া গো
যুবতি-ধরম কৈছে রয়।।
পাসরিতে করি মনে পাসরা না যায় গো
কি করিব কি হবে উপায়।
কহে দ্বিজ চণ্ডীদাসে কুলবতী কুল নাশে
আপনার যৌবন যাচায়।।
২
রাধার কি হৈল অন্তরে ব্যথা।
বসিয়া বিরলে থাকয়ে একলে
না শুনে কাহারো কথা।।
সদাই ধেয়ানে চাহে মেঘ-পানে
না চলে নয়ান-তারা।
বিরতি আহারে রাঙ্গাবাস পরে
যেমত যোগিনী-পারা।।
এলাইয়া বেণী ফুলের গাঁথনি
দেখয়ে খসায়ে চুলি।
হসিত বয়ানে চাহে মেঘ-পানে
কি কহে দুহাত তুলি।।
একদিঠ করি ময়ূর-ময়ূরী
কণ্ঠ করে নিরীক্ষণে।
চণ্ডীদাস কয় নব পরিচয়
কালিয়া-বঁধুর সনে।।
৩
ঘরের বাহিরে দণ্ডে শতবার
তিলে তিলে আইসে যায়।
মন উচাটন নিশ্বাস সঘন
কদম্ব-কাননে চায়।।
রাই এমন কেন বা হৈল।
গুরু দুরজন ভয় নাহি মন
কোথা বা কি দেব পাইল।।
সদাই চঞ্চল বসন-অঞ্চল
সম্বরণ নাহি করে।
বসি থাকি থাকি উঠয়ে চমকি
ভূষণ খসাঞা পরে।।
বয়সে কিশোরী রাজার কুমারী
তাহে কুলবধূ বালা।
কিবা অভিলাষে বাঢ়য়ে লালসে
না বুঝি তাহার ছলা।।
তাহার চরিতে হেন বুঝি চিতে
হাত বাড়াইল চাঁদে।
চণ্ডীদাস কয় করি অনুনয়
ঠেকেছে কালিয়া-ফাঁদে।।
আরও পড়ুন
৪
একে কুলবতী ধনি তাহে সে অবলা।
ঠেকিল বিষম প্রেমে কত সবে জ্বালা।।
অকথন বেয়াধি কহন নাহি যায়।
যে করে কানুর নাম ধরে তার পায়।।
পায়ে ধরি কাঁদে সে চিকুর গড়ি যায়।
সোনার পুতলি যেন ভূমেতে লোটায়।।
পুছয়ে কানুর কথা ছল ছল আঁখি।
কোথায় দেখিলা শ্যাম কহ দেখি সখি।।
চণ্ডীদাস বলে কাঁদে কিসের লাগিয়া।
সে কালা আছয়ে তার হৃদয়ে জাগিয়া।
৫
এমন পিরীতি কভু নাহি দেখি শুনি।
পরাণে পরাণে বান্ধা আপনা আপনি।।
দুহুঁ কোরে দুহুঁ কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া।
আধ তিল না দেখিলে যায় যে মরিয়া।।
জল বিনু মীন যেন কবহু না জীয়ে।
মানুষে এমন প্রেম কোথা না শুনিয়ে।।
ভানু-কমল বলি সেহো হেন নয়।
হিমে কমল মরে ভানু সুখে রয়।।
চাতক-জলদ কহি সে নহে তুলনা।
সময় নহিলে সে না দেয় এক কণা।।
কুসুমে মধুপ কহি সেহো নহে তুল।
না যাইলে ভ্রমর আপনি না দেয় ফুল।।
কি ছাড় চকোর-চান্দ দুহুঁ সম নহে।
ত্রিভুবনে হেন নাহি চণ্ডীদাসে কহে।।
৬
কাহারে কহিব মনের মরম
কেবা যাবে পরতীত
হিয়ার মাঝারে মরম-বেদনা
সদাই চমকে চিত
গুরুজন-আগে দাঁড়াইতে নারি
সদা ছল ছল আঁখি।
পুলকে আকুল দিক নেহারিতে
সব শ্যামময় দেখি।।
সখীর সহিতে জলেতে যাইতে
সে কথা কহিবার নয়।
যমুনার জল করে ঝলমল
তাহে কি পরাণ রয়।।
কুলের ধরম রাখিতে নারিনু
কহিলুঁ সবার আগে।
কহে চণ্ডীদাস শ্যাম সুনাগর
সদাই হিয়ায় জাগে।।
অভিসার পর্যায়
১
এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা
কেমনে আইল বাটে।
আঙ্গিনার মাঝে বঁধুয়া ভিজিছে
দেখিয়া পরাণ ফাটে।।
সই, কি আর বলিব তোরে।
কোন পুণ্যফলে সে হেন বঁধুয়া
আসিয়া মিলল মোর।।
ঘরে গুরুজন ননদী দারুণ
বিলম্বে বাহির হৈনু।
আহা মরি মরি সঙ্কেত করিয়া
কত না যাতনা দিনু।।
বঁধুর পিরীতি আরতি দেখিয়া
মোর মনে হেন করে।
কলঙ্কের ডালি মাথায় করিয়া
আনল ভেজাই ঘরে।।
আপনার দুখ সুখ করি মানে
আমার দুখের দুখী।
চণ্ডীদাস কহে বঁধুর পিরীতি
শুনিতে জগত সুখী।।
আক্ষেপানুরাগ
১
যত নিবারিয়ে চাই নিবার না যায় রে।
আন পথে যাই সে কানু-পথে ধায় রে।।
এ ছার রসনা মোর হইল কি বাম রে।
যার নাম নাহি লই লয় তার নাম রে।।
এ ছার নাসিকা মুই যত করু বন্ধু।
তবু ত দারুণ নাসা পায় শ্যাম-গন্ধ।।
সে না কথা না শুনিব করি অনুমান।
পরসঙ্গ শুনিতে আপনি যায় কান।।
ধিক্ রহু এ ছার ইন্দ্রিয় মোর সব।
সদা সে কালিয়া কানু হয় অনুভব।।
কহে চণ্ডীদাসে রাই ভাল ভাবে আছ।
মনের মরম কথা কারে নাহি পুছ।।
২
কি মোহিনী জান বঁধু কি মোহিনী জান।
অবলার প্রাণ নিতে নাহি তোমা হেন।।
ঘর কৈনু বাহির, বাহির কৈনু ঘর।
পর কৈনু আপন, আপন কৈনু পর।।
রাতি কৈনু দিবস, দিবস কৈনু রাতি।
বুঝিতে নারিনু বন্ধু তোমার পিরীতি।।
কোন্ বিধি সিরজিল সোতের শেঁওলি।
এমন ব্যথিত নাই ডাকি বন্ধু বলি।।
বঁধু যদি তুমি মোরে নিদারুণ হও।
মরিব তোমার আগে দাঁড়াইয়া রও।।
বাশুলী-আদেশে দ্বিজ চণ্ডীদাস কয়।
পরের লাগিয়ে কি আপন পর হয়।।
৩
তোমারে বুঝাই বঁধু তোমারে বুঝাই।
ডাকিয়া সুধায় মোরে হেন জন নাই।।
অনুক্ষণ গৃহে মোরে গঞ্জয়ে সকলে।
নিচয় জানিও মুঞি ভখিমু গরলে।।
এ ছার পরাণে আর কিবা আছে সুখ।
মোর আগে দাঁড়াও তোমার দেখি চাঁদ-মুখ।।
খাইতে সোয়াস্তি নাই নাহি টুটে ভুখ।
কে মোর ব্যথিত আছে কারে কব দুখ।।
চণ্ডীদাস কহে রাই ইহা না যুয়ায়।
পরের বোলে কেবা প্রাণ ছাড়িবারে চায়।
ক্রমশ…