চৈতন্যদেব জীবন-কথা
বাংলা সাহিত্যে মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্যদেব কে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে নানা সাহিত্য যা চৈতন্যজীবনী সাহিত্য হিসেবে পরিচিত। তাছাড়া পদাবলি সাহিত্যেও আছে মহাপ্রভুর প্রভাব। আমরা এই আলোচনায় মুখ্যত চৈতন্যদেবের জীবন-কথা পরিবেশন করেছি। চৈতন্যদেবের জীবনের ঘটনা ও তত্ত্বগত পর্যায়ক্রমে আলোচনা করা হল।
পর্ব বিন্যাস
চৈতন্যদেব -এর জীবনের ঘটনা ও তত্ত্বগত পর্যায় বিশ্লেষণ করলে তিনটি পর্ব স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায়।
১. প্রথম পর্ব বা গৌড়পর্ব :– জন্ম (১৪৮৬ খ্রিঃ) থেকে চব্বিশ বছর বয়সে সন্ন্যাস গ্রহন (১৫১০ খ্রিঃ) পর্যন্ত এই পর্বের সীমা। (১৪৮৬-১৫১০ খ্রিঃ)
২. দ্বিতীয় পর্ব বা পরিব্রাজক পর্ব :– সন্ন্যাস গ্রহনের (১৫১০ খ্রিঃ) পর থেকে তিনি প্রায় পাঁচ বছর দক্ষিণ-ভারত,পশ্চিম-ভারত ও মথুরা-বৃন্দাবন পরিক্রমা করেন। এটাই চৈতন্যের জীবনের দ্বিতীয় পর্ব বা পরিব্রাজক পর্ব।(১৫১০-১৫১৫ খ্রিঃ)
৩. অন্ত্যপর্ব বা নীলাচল পর্ব :– পরিব্রাজক-জীবনের পর তিনি জীবনের শেষ আঠারো বছর নীলাচলে স্হায়ী ভাবে বাস করেছিলেন। এই পর্বের নাম অন্ত্য পর্ব বা নীলাচল পর্ব।(১৫১৫-১৫৩৩ খ্রিঃ)
পূর্বপুরুষ পরিচয়
মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্যদেব -এর পিতৃভূমি গৌড়দেশ নয় – শ্রীহট্টে। চৈতন্যের পিতা জগন্নাথ মিশ্র ( মিশ্র পুরন্দর)। মাতামহ নীলাম্বর চক্রবর্তী শ্রীহট্ট ত্যাগ করে গঙ্গার তীরে নবদ্বীপে এসে বসবাস করেন। নবদ্বীপে নীলাম্বরের কন্যা শচীদেবীর সাথে জগন্নাথ মিশ্রের বিবাহ হয়। জগন্নাথ-শচীদেবীর কনিষ্ঠ পুত্র চৈতন্যদেব। জগন্নাথ মিশ্রের জ্যেষ্ঠ পুত্র হলেন বিশ্বরূপ যিনি সংসার ধর্ম ত্যাগ করে সন্ন্যাস ধর্ম গ্রহণ করে ছিলেন।
চৈতন্যদেবের জন্ম হয় ১৪৮৬ খ্রিঃ ২৭ ফেব্রুয়ারি, ৮৯২ বঙ্গাব্দের ২৩ শে ফাল্গুন, ১৪০৭ শকাব্দে শুক্র বা শনিবার পূর্ণিমা চন্দ্রগ্রহণের পূর্বে সন্ধ্যায়।
চৈতন্যদেব বিভিন্ন নাম
১. নিমাই – শচীদেবীর অনেকগুলি সন্তানের মৃত্যুর পর চৈতন্যের জন্ম হয়েছিল বলে তার নাম রাখা হয় নিমাই অর্থাৎ নিমের মতো তিক্ত — যাতে ‘নিমাই’ নামের জন্য যম ও বালকটিকে ছুঁতে পারবেনা। নিমাই নামকরন করেন অদ্বৈত-পত্নী সীতাদেবী।
২.বিশ্বম্ভর মিশ্র – চৈতন্যের পোষাকি নাম বিশ্বম্ভর মিশ্র।
৩. শ্রীগৌরাঙ্গ – নিমাই অতিশয় গৌরবর্ণ ছিলেন বলে গৌরাঙ্গ নামেও পরিচিত ছিলেন। (অপভ্রংশে ও শ্রদ্ধায় গোরা,গোরাচাঁদ,গোরা-রায় ইত্যাদি)
৪. শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য বা সংক্ষেপে চৈতন্য – ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে কাটোয়ার কেশব ভারতীর কাছে সন্ন্যাস নেওয়ার পর নিমাই শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য বা সংক্ষেপে শ্রীচৈতন্য নামে দেশে-বিদেশে পরিচিত হন। এই নামটি গুরু কেশব ভারতীর প্রদত্ত।
৫. এছাড়া ‘মহাপ্রভু’ নামটিও প্রচলিত আছে।
বিদ্যার্জন
১৪৯১ খ্রিস্টাব্দে নিমাইয়ের হাতে খড়ি হয়। দুরন্ত নিমাইকে গঙ্গাদাস পণ্ডিতের টোলে ভর্তি করে দেওয়া হয়। এখানে মুরারি গুপ্ত নিমাই এর সহপাঠী ছিলেন। ১৪৯২ খ্রিঃ নিমাই এর দাদা বিশ্বম্ভর সন্ন্যাস নেন। ১৪৯৭ খ্রিঃ জগন্নাথ মিশ্র মারা যান। পিতার মৃত্যুর পর নিমাই পণ্ডিত মুকুন্দের চণ্ডীমণ্ডপে টোল খুলে ছাত্র পড়ানো শুরু করেন।
এইসময় নিমাই বিখ্যাত পণ্ডিত দিগ্বিজয়ীকে তর্কযুদ্ধে পরাজিত করেন। নিমাই এর প্রথম শিষ্য হলেন তপন মিশ্র।
শিক্ষাষ্টক – সংস্কৃত ভাষায় চৈতন্যদেব রচিত আটটি শ্লোক ‘শিক্ষাষ্টক’ নামে পরিচিত। এটিই চৈতন্যদেবের একমাত্র রচনা। শ্রীরূপ গোস্বামীর ‘পদ্যাবলী’ গ্রন্থে এই শ্লোকগুলি সংকলিত আছে। ‘শিক্ষাষ্টক’ প্রকৃতপক্ষে মহৎ বৈষ্ণব জীবনের আদর্শ ও কৃষ্ণভক্তিমূলক উপদেশাত্মক রচনা।
বিবাহ
বল্লভ আচার্যের কন্যা লক্ষ্মীপ্রিয়ার সাথে নিমাইয়ের বিবাহ হয় ১৫০১-০২ খ্রিঃ। পাত্রী নিমাইয়ের নির্বাচিত। ঘটক বনমালী আচার্য।
এরপর সংসারের দারিদ্র মোচন করতে ১৫০৬ খ্রিঃ পিতৃভূমি পূর্ববঙ্গে যান। এই সময়েয় সর্পাঘাতে লক্ষীপ্রিয়া মারা যান (১৫০৬)। এই ঘটনায় নিমাই মর্মাহত হলেন। শচীদেবী পুনরায় ছেলের বিবাহ দিতে সচেষ্ট হলেন। সনাতন পণ্ডিতের কন্যা বিষ্ণুপ্রিয়ার সাথে নিমাই এর বিবাহ স্থির হল, ঘটক কাশীনাথ পন্ডিত। আনুমানিক ১৫০৭ খ্রিঃ এই বিবাহ সুসম্পন্ন হয়।
সন্ন্যাস গ্রহণ
১. ১৫০৮ খ্রিঃ গয়াতে পিতৃপিণ্ড দিতে গিয়ে ঈশ্বর পুরীর কাছে দশাক্ষর গোপালমন্ত্রে দীক্ষা নেন নিমাই।
২. ১৫১০ খ্রিঃ ১০ জানুয়ারী কাটোয়ার কেশব ভারতীর কাছে সন্ন্যাস নেন এবং গুরু প্রদত্ত নাম ‘শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’ বা ‘শ্রীচৈতন্য’ নাম ধারণ করেন।
দ্বিতীয় পর্ব বা পরিব্রাজক পর্ব (১৫১০-১৫১৫ খ্রিঃ) – সন্ন্যাস গ্রহণের (১৫১০ খ্রিঃ) পর থেকে তিনি প্রায় পাঁচ বছর দক্ষিণ-ভারত, পশ্চিম-ভারত ও মথুরা-বৃন্দাবন পরিক্রমা করেন। এটাই চৈতন্যের জীবনের দ্বিতীয় পর্ব বা পরিব্রাজক পর্ব।
অন্ত্যপর্ব বা নীলাচল পর্ব (১৫১৫-১৫৩৩ খ্রিঃ) – পরিব্রাজক-জীবনের পর তিনি জীবনের শেষ আঠারো বছর নীলাচলে স্থায়ীভাবে বাস করেছিলেন। এই পর্বের নাম অন্ত্য পর্ব বা নীলাচল পর্ব।
এই পর্বে বাসুদেব আচার্য ও উড়িষ্যার রাজা প্রতাপরুদ্র চৈতন্যদেবের প্রতি আকৃষ্ট হন। এই পর্বে হরিদাস, স্বরূপ-দামোদর (পুরুষোত্তম আচার্য), পরমানন্দপুরী এবং রায় রামানন্দ চৈতন্যদেবের সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিলেন।
তিরোধান
১৫৩৩ খ্রিঃ ২৯ জুন বা জুলাই যুগাবতার শ্রীচৈতন্য মর্ত্যধাম ত্যাগ করেন। চৈতন্যদেবের তিরোধান সম্পর্কে কয়েকটি মত পাওয়া যায়।
১. দিব্যোন্মাদ অবস্থায় সমুদ্র জলের কৃষ্ণ দেহবর্ণের স্বারূপ্য ভাবনায় তিনি সমুদ্রের জলে ঝাঁপ দিয়ে সমুদ্রে লীন হয়ে যান।
২. জগন্নাথের শরীরে তিনি লীন হয়ে গিয়েছিলেন। (‘চৈতন্যমঙ্গল’- লোচনদাস)
৩. আষাঢ় মাসের রথযাত্রায় নৃত্যরত অবস্থায় পায়ে ইঁটের আঘাত লাগে, তা থেকেই চৈতন্য দেবের দেহাবসান ঘটে। (‘চৈতন্যমঙ্গল’– জয়ানন্দ)
৪. পুরীতে এমন জনশ্রুতি প্রচলিত আছে যে,পাণ্ডারা চৈতন্য-মহিমা ও প্রভাব দর্শনে ঈর্ষাতুর হয়ে চৈতন্যদেবকে নাকি মন্দিরের মধ্যে নিহত করে মন্দির প্রাঙ্গনেই সমাহিত করে প্রচার করে দেন তিনি জগন্নাথ শরীরে লীন হয়ে গেছেন। বলা বাহুল্য এই তথ্যটি গল্পবুভুক্ষু সাধারণ মানুষের কল্পনা প্রসূত।
আমাদের ভিডিও টিউটোরিয়াল দেখুন