গদ্য ও প্রবন্ধবাংলা সাহিত্য

গদ্যশিল্পী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

বাংলা সাহিত্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর -এর অবদান নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। অনুবাদ, মৌলিক রচনা, শিশুসাহিত্য, ব্যঙ্গমূলক রচনা – গদ্যসাহিত্যের সর্বত্র তাঁর বিচরণ। আমাদের এই পোস্টে তাঁর জীবন ও সাহিত্য বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।

জন্ম ও বংশ পরিচয়

বর্তমান পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ২৬ শে সেপ্টেম্বর ১৮২০ খ্রিঃ জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা ঠাকুরদাস বন্দোপাধ্যায় । মাতা ভগবতী দেবী। পিতামহ রামজয় তর্কভূষন ছিলেন সুপন্ডিত ও দৃঢ়চেতা মানুষ । পিতামহই নাম রাখেন ঈশ্বরচন্দ্র । তার দাম্পত্য সঙ্গীর নাম দীনময়ী দেবী। তার একমাত্র পুত্র নারায়ণ চন্দ্র বিদ্যারত্ন। ১৮৯১ খ্রিঃ ২৯ শে জুলাই তাঁর মৃত্যু হয়।

শিক্ষা‬ জীবন

ঈশ্বর চন্দ্র ৪ বছর ৯ মাস বয়সে গ্রামের সনাতন বিশ্বাসের পাঠশালায় শিক্ষা জীবন শুরু । কিন্তু তিনি শিক্ষা দান অপেক্ষা বেত্র দানই বেশি করতেন । পিতামহ তাকে কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের পাঠশালায় ভর্তি করেন। তখন তার বয়স ৭ বছর । ঈশ্বরচন্দ্রের চোখে কালীকান্তই ছিলেন আদর্শ শিক্ষক । পরে ১৮২৮ সালে ৮ বছর বয়সে তিনি পিতার সঙ্গে কলকাতায় চলে আসেন। তার পিতা কলকাতায় সামান্য চাকরি করতেন। থাকতেন কলকাতার বড়বাজারের ভগবত চরণ বাবুর বাড়িতে । এই ভগবত চরণের বিধবা কনিষ্ঠা কন্যা রাইমনি দেবীর স্নেহ ঈশ্বর চন্দ্রের মনকে গভীর ভাবে স্পর্শ করে।

পরবর্তী কালে নারী কল্যাণ মুলক কাজের পশ্চাতে তার মায়ের পাশাপাশি এই রাইমনি দেবীরও প্রভাব পরেছে । যাই হোক কলকাতায় আসার পর ১৮২৯ সালের ১ লা জুন সংস্কৃত কলেজে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। তিনি খুব দ্রুত শিক্ষা আয়ত্ত করতে থাকেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র । খুব কম সময়ের মধ্যেই তিনি ব্যাকরণ , অলংকার , স্মৃতি , বেদান্ত, ন্যায়দর্শন, মীমাংসা , সংস্কৃত সাহিত্যে বুৎপত্তি লাভ করেন। ১৮৩৯ সালে তিনি ত্রিপুরায় জেলা জজ পণ্ডিতের পদে চাকরি পান। কিন্তু পিতার ইচ্ছায় তিনি আরও পড়াশুনা চালিয়ে যান। শেষে ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃত কলেজের শিক্ষা সমাপ্ত করেন।

উপাধি

১৮৩৯ সালের ২২ এপ্রিল হিন্দু ল কমিটির পরীক্ষা দেন ঈশ্বরচন্দ্র। এই পরীক্ষাতে যথারীতি কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে ১৬ মে ল কমিটির কাছ থেকে যে প্রশংসাপত্রটি পান, তাতেই প্রথম তাঁর নামের সঙ্গে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধিটি ব্যবহৃত হয়।

সংস্কৃত কলেজে বারো বছর পাঁচ মাস অধ্যয়নের পর তিনি এই কলেজ থেকে অপর একটি প্রশংসাপত্র লাভ করেন। ১৮৪১ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রাপ্ত প্রশংসাপত্রে কলেজের অধ্যাপকগণ ঈশ্বরচন্দ্রকে ‘বিদ্যাসাগর’ নামে অভিহিত করেন।

এছাড়াও সরকারের পক্ষ থেকে তিনি ১৮৮০ সালে CIE উপাধি পান।

কর্ম‬ জীবন

১৮৪১ সালে শিক্ষা সমাপ্তের পর ২১ বছর বয়সে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রধান পণ্ডিতের পদে নিযুক্তির মাধ্যমে তার কর্ম জীবন শুরু । এরপর –
১৮৪৬ – সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পদক।
১৬ ই জুলাই , ১৮৪৭- সম্পদকের পদ ত্যাগ ।
১৮৪৯ – ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের হেডরাইটার ও কোষাধক্ষ।
১৮৫০ – সংস্কৃত কলেজের সাহিত্যের অধ্যাপক ।
১৮৫১ – সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ।
১৮৫৫- সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শক।
১৮৫৮- অধ্যক্ষের পদ ত্যাগ

এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কমিটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ।

‪‎সমাজ‬ সংগঠন 

নবজাগরণের অন্যতম প্রাণপুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আজীবন নিরলস ভাবে কাজ করে গেছেন সমাজের জন্য । বিশেষ করে তার নারী কল্যাণ মূলক কাজের জন্য তিনি ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন । তারই একান্ত প্রচেষ্টায় বহু প্রশংসিত বিধবা বিবাহ আইন (১৮৫৬) পাশ হয়। এর পাশাপাশি নারী শিক্ষা বিস্তার এবং বহুবিবাহ প্রথা রধের জন্য গরে তুলেছেন আনন্দোন। স্ত্রী শিক্ষা বিস্তারের জন্য স্থাপন করেছেন বহু বালিকা বিদ্যালয়। স্থাপন করেছেন মেট্রপলিটন কলেজ যা বর্তমানে বিদ্যাসাগর কলেজ নামে পরিচিত ।
এছাড়াও অসংখ্য জনহিতকর কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি । খুব কম বয়স থেকেই তিনি ছিলেন দয়ালু। আর্থিক সাহায্য করেছেন বহু মানুষ এবং প্রতিষ্ঠানকে। তাই তিনি দয়ারসাগর হিসাবে চিরস্মরণীয় থাকবেন ।

মাইকেল মধুসূদনের মতে বিদ্যাসাগরের মধ্যে ছিল প্রাচীন ঋষির প্রজ্ঞা, ইংরেজের কর্মশক্তি এবং বাঙালি মায়ের হৃদয়বৃত্তি। ১৮৬৪ সালে ইংল্যাণ্ডের ‘রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটি তাকে সান্মানিক সদস্য নির্বাচন করে যা খুব কম ভারতীর পক্ষে জুটে ছিল।

সাহিত্যকর্ম

শিক্ষামূলক গ্রন্থ  বর্ণপরিচয় (১ম ও ২য় ভাগ ; ১৮৫৫) ঋজুপাঠ (১ম, ২য় ও ৩য় ভাগ ; ১৮৫১-৫২) সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা (১৮৫১) ব্যাকরণ কৌমুদী (১৮৫৩)।

অনুবাদ গ্রন্থ

হিন্দি থেকে বাংলা বেতাল পঞ্চবিংশতি (১৮৪৭ ; লল্লুলাল কৃত বেতাল পচ্চীসী অবলম্বনে)
সংস্কৃত থেকে বাংলা শকুন্তলা (ডিসেম্বর, ১৮৫৪ ; কালিদাসের অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ অবলম্বনে) সীতার বনবাস (১৮৬০ ; ভবভূতির উত্তর রামচরিত ও বাল্মীকি রামায়ণ-এর উত্তরাকান্ড অবলম্বনে)
মহাভারতের উপক্রমণিকা (১৮৬০ ; ব্যাসদেব মূল মহাভারত-এর উপক্রমণিকা অংশ অবলম্বনে)
বামনাখ্যানম্ (১৮৭৩ ; মধুসূদন তর্কপঞ্চানন রচিত ১১৭টি শ্লোকের অনুবাদ)
ইংরেজি থেকে বাংলা বাঙ্গালার ইতিহাস (১৮৪৮ ; মার্শম্যান কৃত হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল অবলম্বনে রচিত)
জীবনচরিত (১৮৪৯ ; চেম্বার্সের বায়োগ্রাফিজ অবলম্বনে রচিত)
নীতিবোধ (প্রথম সাতটি প্রস্তাব – ১৮৫১ ; রবার্ট ও উইলিয়াম চেম্বার্সের মরাল ক্লাস বুক অবলম্বনে রচিত)
বোধোদয় (১৮৫১ ; চেম্বার্সের রুডিমেন্টস অফ নলেজ অবলম্বনে রচিত)
কথামালা (১৮৫৬ ; ঈশপস ফেবলস অবলম্বনে রচিত)
চরিতাবলী (১৮৫৭ ; বিভিন্ন ইংরেজি গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা অবলম্বনে রচিত)
ভ্রান্তিবিলাস (১৮৬১ ; শেক্সপিয়রের কমেডি অফ এররস অবলম্বনে রচিত)

ইংরেজি গ্রন্থ
পোয়েটিক্যাল সিলেকশনস্ সিলেকশনস্ ফ্রম গোল্ডস্মিথ সিলেকশনস্ ফ্রম ইংলিশ লিটারেচার

মৌলিক গ্রন্থ
সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৫৩) বিধবা বিবাহ চলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৫৫) বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৭১) অতি অল্প হইল (১৮৭৩) আবার অতি অল্প হইল (১৮৭৩) ব্রজবিলাস (১৮৮৪) রত্নপরীক্ষা (১৮৮৬) প্রভাবতী সম্ভাষণ (সম্ববত ১৮৬৩) জীবন-চরিত (১৮৯১ ; মরণোত্তর প্রকাশিত) শব্দমঞ্জরী (১৮৬৪) নিষ্কৃতি লাভের প্রয়াস (১৮৮৮) ভূগোল খগোল বর্ণনম্ (১৮৯১ ; মরণোত্তর প্রকাশিত)

সম্পাদিত গ্রন্থ
অন্নদামঙ্গল (১৮৪৭) কিরাতার্জ্জুনীয়ম্ (১৮৫৩) সর্বদর্শনসংগ্রহ (১৮৫৩-৫৮) শিশুপালবধ (১৮৫৩) কুমারসম্ভবম্ (১৮৬২)

বিদ্যাগরের গদ্যভাষার বৈশিষ্ট্যঃ

১. বিদ্যাসাগরের ভাষা অতি সুমধুর ও মনোহর।
২. বাংলা গদ্যের গলিপথ কে রাজপথে পরিণত করেছেন ।
৩. পরিমিতি ও লালিত্য সঞ্চার করে বাংলা গদ্যকে সজীব ও সতেজ করে তুলেছেন।
৪. তিনি বাংলা সাধু গদ্য রীতির ছাদটি গরে দিয়েছেন।
৫. উপযুক্ত স্থানে যতি চিহ্নের ব্যবহার ।
৬. শব্দ , পদ, বাক্য , শ্বাসাঘাত , ধ্বনিঝংকার – সমস্ত কিছুরই যথাযথ প্রয়োগ করেছেন ।
৭. তবে তিনি সংস্কৃত শব্দের ব্যবহার বেশি করেছেন ।
৮. তবে শকুন্তলা ও সীতার বনবাস গ্রন্থ দুটির ভাষা অনেক সাবলীল । সেখানে অনেক তদ্ভব ও দেশি শব্দও ব্যবহার করেছেন । সংলাপ গুলি অনেকটা চলিত ভাষার কাছাকাছি ।
৯. সামসবদ্ধ পদের ব্যবহার এবং অসমাপিকা ক্রিয়া দ্বারা জটিল বাক্য নির্মাণ তার গদ্যের বৈশিষ্ট্য ।
১১. রবীন্দ্রনাথ বলেছেন – “বাংলা গদ্যের প্রথম যথার্থ শিল্পী “

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *