গদ্য ও প্রবন্ধ

কালীপ্রসন্ন সিংহ – বাংলা সাহিত্যের হুতোম

কলকাতার জোড়াসাঁকো অঞ্চলে এক ধনী জমিদার পরিবারে ১৮৪০ খ্রীস্টাব্দে কালীপ্রসন্ন সিংহ (১৮৪০ – ১৮৭০) জন্মগ্রহণ করেন। ইনি ছিলেন প্রসিদ্ধ দেওয়ান শান্তিরাম সিংহের প্রপৌত্র, জয়কৃষ্ণ সিংহের পৌত্র, নন্দলাল সিংহের একমাত্র পুত্র। বাংলা সাহিত্যে তিনি মূলত তাঁর দুটি কর্মের কারণে স্মরণীয় হয়ে আছেন। একটি হল ব্যাসদেব বিরচিত মহাভারতের বাংলা অনুবাদ আর অন্যটি হল ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’। কালীপ্রসন্ন সিংহ – বাংলা সাহিত্যের হুতোম শীর্ষক এই পোস্টে লেখকের জীবন ও সাহিত্য বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে।

কালীপ্রসন্ন সিংহ – শিক্ষা

কালীপ্রসন্ন সিংহ শৈশবে হিন্দু কলেজে শিক্ষালাভ করেন। বাড়িতে তিনি উইলিয়াম কার্কপ্যাটরিক নামে এক সাহেবের কাছ থেকে সযত্নে ইংরেজী শিক্ষা নেন। সংস্কৃত ভাষাতেও ছিল তাঁর পাণ্ডিত্য।

কর্মজীবন

বঙ্গভাষা অনুশীলনের জন্য মাত্র তেরো (১৩) বছর বয়সে “বিদ্যোৎসাহিনী সভা” প্রতিষ্ঠা (১৪ই জুন, ১৮৫৩) করেন। এই সভা বাংলা সাহিত্য – সংস্কৃতি ও সমাজ – সংস্কার ইত্যাদি নানাবিধ প্রগতিমূলক কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই সভার সম্পাদকরূপে প্রথমে কালীপ্রসন্ন, পরে উমেশচন্দ্র মল্লিক, ক্ষেত্রনাথ বসু, রাধানাথ বিদ্যারত্ন। এছাড়াও আরো নানান প্রমূখ স্বনামধন্য ব্যক্তি এই সভার সদস্য হন। এর মাধ্যমেই সি. জি. মনটেগিউ, কার্কপ্যাটরিক প্রমূখর বক্তৃতা, মধুসূদন এবং পাদরী লঙকে সম্বর্ধনাদান, বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ কাজের সমর্থনে স্বাক্ষর সংগ্রহ – এভাবে বিবিধ কাজ করা হয়। বিদ্যোৎসাহিনী সভার অধীনে ‘বিদ্যোৎসাহিনী রঙ্গমঞ্চ’ প্রতিষ্ঠা (১৮৫৬) কালীপ্রসন্নের উদ্যোগেই সম্ভব হয়। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যেমন – বিদ্যোৎসাহিনী (মাসিক পত্রিকা), সর্বতত্ত্বপ্রকাশিকা, বিবিধার্থ-সংগ্রহ, পরিদর্শক ইত্যাদি ।

কালীপ্রসন্ন সিংহ – রচনাবলী 

“বাবুনাটক” (১৮৫৪), “বিক্রমোর্ব্বশী নাটক” (১৮৫৭) , “সাবিত্রী সত্যবান নাটক” (১৮৫৮), “মালতীমাধব নাটক” (১৮৫৯), “হুতোম প্যাঁচার নকশা” (১৮৬১-৬২) , “পুরাণসংগ্রহ” (১৮৬০-৬৬) , “বঙ্গেশবিজয়” (১৮৬৮,অসমাপ্ত) , “শ্রীমদ্ভগবদগীতার বঙ্গানুবাদ” (১৯০২) ।

অবদান

মাত্র তিরিশ (৩০) বছর বয়সের সংক্ষিপ্ত জীবন পরিচিতির মধ্যে বাঙালী জাতি ও বাংলা সাহিত্যের জন্য যিনি রেখে গেছেন এক অতুলনীয় সারস্বতার্ঘ্য, তিনি হলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর দীপ্তিমান নক্ষত্র কালীপ্রসন্ন সিংহ।

বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর এক অসামান্য সাহিত্যকীর্তি “হুতোম প্যাঁচার নকশা”। এই কীর্তির পিছনে রয়েছে এর ভাষা । লোকজীবনের প্রাত্যহিক বিবরণে চলিত ভাষা যে সার্থক মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে এই গ্রন্থের দ্বারাই তা প্রমাণিত। আবার, হাস্য পরিহাস বা ব্যঙ্গ বিদ্রুপ প্রয়োগেও চলিত গদ্যের উপযোগীতা প্রমাণিত হয়। কালীপ্রসন্ন প্রথম শ্রেণির ভাষাস্রষ্ঠা হয়েও তাঁর অনুতাপ ছিল, তাঁর বক্তব্য বঙ্কিমচন্দ্রের ভালো লাগেনি। সাহিত্যসম্রাটের উপেক্ষা থাকা সত্ত্বেও প্রবন্ধটি স্বমহিমায় বাংলা গদ্য সাহিত্যে এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন হয়ে রয়েছে। কালীপ্রসন্ন সিংহ তাঁর এই সংক্ষিপ্ত জীবনে কেবল সাতিহ্যচর্চা এবং প্রগতিশীল আন্দোলনের অন্যতম পুরোধারূপেই বন্দিত নন, বাংলা গদ্যসাহিত্যের ইতিহাসে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব রূপেও তিনি নন্দিত ।

সর্বশেষ সংশোধিত – ১০.১১.২০২৪

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *