ধ্বনিতত্ত্ব

লিপি বিবর্তন – Scripts Variation

যেকোন ভাষার অন্যতম উপাদান তার লিপি। আদিমকাল থেকেই মানুষ তার কোনো অনুভূতি প্রকাশ বা কোনো বিষয়কে ব্যক্ত করার মাধ্যমের সন্ধান করেছে। আর সেই প্রবণতাতেই জন্ম হয়েছে বিভিন্ন লিপির। আমাদের লিপি বিবর্তন – Scripts Variation এই আলোচনায় ভারতের বাইরে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সৃষ্টি হওয়া লিপি সম্পর্কে সুসংবদ্ধ আলোচনা করা হয়েছে। আমাদের অন্য একটি আলোচনায় ভারতীয় লিপি সম্পর্কে জানতে পারবেন।

লিপি (Scripts Variation) বিবর্তন কথা

লিপিরূপের বিবর্তনে (Scripts Variation) চারটি স্তর দেখা যায় – চিত্রলিপি ও গ্রন্থিলিপি (Pictogram and Quipu), ভাবলিপি (Ideogram), চিত্রপ্রতীক লিপি (Hierograph) এবং ধ্বনিলিপি (Phonogram)। নীচে প্রতিটি লিপির সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হল।

চিত্রলিপি ও গ্রন্থিলিপি

আদিম কালের মানুষ মনের ভাবকে লিখে রাখতে প্রথমত চিত্র অঙ্কন পদ্ধতি গ্রহণ করেছিল। সে তার জীবনের বিশেষ কোন ঘটনা, বীরত্বের কাহিনী বা মনে দাগ কাটা বিষয়কে ধরে রাখার জন্য গুহার দেওয়ালে, পর্বতগাত্রে বা গাছের গুঁড়িতে ছবি এঁকে রাখত। এই পদ্ধতিকে লিপিবিজ্ঞানের ভাষায় চিত্রলিপি বলা হয়। এই পদ্ধতিতে বস্তু বা জন্তুর চিত্রই অঙ্কিত হত। স্পেনের আলতামিরা গুহাচিত্র, ফ্রান্সের শভে গুহাচিত্র প্রায় ত্রিশ হাজার বছরের পুরানো।

ছবি আঁকা ছাড়াও প্রাত্যহিক কাজের হিসাব, রাজার নির্দেশ, বিশেষ কোন ঘটনার বিবরণ প্রভৃতি বিষয় লিপিবদ্ধ করবার জন্য কোনো কোনো দেশে গ্রন্থিলিপি প্রচলিত ছিল। দড়িতে বেঁধে, লাঠির গায়ে দাগ কেটে, হাতের পাঞ্জার ছাপ, গাছের ডালে ন্যাকড়া বেঁধে, পুঁতি দিয়ে কোমরবন্ধ তৈরী করে মনের ভাব প্রকাশ করা চলত।
দড়িতে গিঁট বেঁধে যে গ্রন্থিলিপি তা প্রচলিত ছিল পেরুতে। একে কুইপান বা কুইপু বলা হয়। পলিনেশিয়া, টাঙ্গানাইকা, প্রাচীন চীনেও এই পদ্ধতির অনুসরণ দেখা যায়।

ভাবলিপি

চিত্রিলিপির শেষে ভাবলিপির (Ideogram) উদ্ভব দেখা যায়। ভাবলিপি কোনো স্বতন্ত্র লিপিপদ্ধতি নয়। এটি চিত্রলিপিরই পরিপূরক। এক্ষেত্রে চিত্রাঙ্কন পদ্ধতি অনেক সরল হয়ে এল। তখন আর কোনো বস্তুর বা জন্তুর সম্পূর্ণ ছবি না এঁকে কয়েকটি রেখার সাহায্যে উদ্দিষ্ট বস্তু বা জন্তুকে বোঝানো হতে লাগল। চিত্র এখানে অনেকটাই প্রতীক। বস্তু নয়, তার ভাবকেই প্রাধান্য দেবার চেষ্টা হল এই লিপিতে।

প্রাচীন মিশর, মেসোপটেমিয়া, ক্রিট, হিট্টি, চীন, ক্যালিফোর্নিয়া, অস্ট্রেলিয়া, লাতিন আমেরিকায় মায়া ও আজটেকদের মধ্যে এই লিপির বহুল প্রচলন ছিল।

চিত্রপ্রতীক লিপি

চিত্রলিপি ও ভাবলিপির স্তরে চিত্র ও রেখাগুলি কোনো বস্তু, তার ভাব বা ক্রিয়াকে বোঝাত। কিন্তু চিত্রপ্রতীক লিপিতে অঙ্কিত চিহ্নহুলি ঐ বস্তুর বা ভাবের নামবাচক শব্দ বা ধ্বনিগুচ্ছের দ্যোতক হয়ে উঠল। ক্রমে বিবর্তনের (Scripts Variation) মাধ্যমে এক সময় তা এমন একটা পর্যায়ে এসে উত্তীর্ণ হল, যখন এই সংক্ষিপ্ত ও সাংকেতিক চিহ্নগুলি ধ্বনির প্রতীক হয়ে উঠল। বিষয় লিপিতে এই স্তরের নাম শব্দলিপি (Logogram)।

ধ্বনিলিপি

এরপর শব্দলিপির চিহ্নগুলি ক্রমে ক্রমে আরো সরল ও ছোটো হয়ে এল এবং এগুলি গোটা একটা শব্দের প্রতীক না হয়ে ঐ শব্দের আদি অক্ষরকে (Syllable) বোঝাতে লাগল। জন্ম হল অক্ষর বা দললিপির (Syllabic Script)।

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে যুক্ত হোন

অক্ষর বা দললিপিও লিপি বিবর্তনের ক্রমিক ধারায় আরো সূক্ষ্ম ও বিশ্লিষ্ট চিহ্নে রূপান্তরিত হল। এই পর্যায়ে এক একটি চিহ্ন পূর্ণ কোনো দল বা অক্ষরের প্রতীক না হয়ে, একক কোনো ধ্বনিকে বোঝাতে লাগল। একক এই ধ্বনির লিখিত রূপ যেহেতু বর্ণ, তাই এই লিপিকে বর্ণলিপি (Alphabetic Script) বলা হয়।

অন্যান্য লিপি

এই চার প্রকার লিপি ছাড়াও পরবর্তীকালে (Scripts Variation) আমরা আরো বেশ কিছু লিপির সন্ধান পেয়েছেন লিপি বিজ্ঞানীরা। কালানুক্রমিক ভাবে প্রাপ্ত সেই সমস্ত লিপিগুলি সম্পর্কেও আলোচনা করা হল এই প্রবন্ধে।

কিউনিফর্ম লিপি

লিপি বিজ্ঞানীরা মনে করেন, প্রাচীন মেসোপটেমিয়া বা সুমেরীয় অঞ্চলে এবং মিশরে পৃথিবীর প্রাচীনতম লিপির উদ্ভব ঘটেছিল। প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে উদ্ভূত সুমেরের ইয়েক শহরে আবিষ্কৃত লিপিগুলিকে বলা হয় কিউনিফর্ম লিপি বা কীলকাক্ষর। লাতিন ভাষায় Cuneus এর অর্থ কীলক বা পেরেক এবং Forma র অর্থ আকৃতি। লিপিগুলির আকৃতি অনেকটাই পেরেকের মতো ছিল, ফলে এই নাম।

কিউনিফর্ম লিপিতে এক সময় দু হাজারের বেশি চিহ্ন ব্যবহৃত হত। পরে তা কমে ৫৭০ য় এসে দাঁড়ায়। এই লিপি, অক্ষর লিপি পর্যন্ত বিবর্তিত হওয়ার পরে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যায়। এর কোনো আধুনিক রূপ পাওয়া যায় না। লিপিবিদ স্যার হেনরি ক্লেসউইক রলিংসন ইরানের বেহিস্তান পাহাড়ে সর্বপ্রথম এই লিপির সন্ধান পান এবং বহু বছরের চেষ্টায় তার পাঠোদ্ধার করেন।

হায়ারোগ্লিফিক লিপি

কিউনিফর্ম লিপির প্রায় সমসময়ে মিশরে যে লিপির প্রচলন ছিল, তার নাম হায়ারোগ্লিফিক লিপি। ‘হায়ারোগ্লিফিক’ শব্দটি গ্রিক। hieros অর্থাৎ পবিত্র এবং gly phein অর্থাৎ খোদাই করা। আর gramma কথার অর্থ বর্ণ বা অক্ষর। ‘হায়ারোগ্লিফিক’ কথার অর্থ খোদাই করা পবিত্র অক্ষর। এই লিপির বয়স খ্রিষ্টপূর্ব চার হাজার বছরের বেশি। কিউনিফর্ম লিপির তুলনায় এই লিপির চিহ্ন সংখ্যা অনেক কম। প্রথম পর্বে ২৪ এবং দ্বিতীয় পর্বে তা বেড়ে হয় ৭৫ টি। এই লিপি ডান দিক থেকে বাম দিকে লেখা হত। ১৭৯৯ খ্রিঃ নেপোলিয়নের সৈন্যদলের এক ক্যাপ্টেন এন. বুসার মিশরের রোজেটা নামক স্থানে যে প্রস্তরলিপি আবিষ্কার করেন সেখানেই প্রথম হায়ারোগ্লিফিক লিপির সন্ধান পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে দীর্ঘ তেইশ বছরের পরিশ্রমে ফরাসি ভাষাবিদ জ্যা ফ্রাসোয়া শা পোলিয়ে তার সম্পূর্ণ অর্থ উদ্ধার করেন।

সিনাইটিক লিপি

মধ্য প্রাচ্যের সিনাই উপদ্বীপে হায়ারোগ্লিফিক লিপি প্রভাবিত যে লিপিরূপ প্রচলিত ছিল তার নাম সিনাইটিক লিপি। এ লিপির বিশেষত্ব হল, এখানে একটি চিহ্নের জন্য একটিই ছবি ব্যবহৃত হত এবং তা একটি মাত্র সুনির্দিষ্ট অর্থের দ্যোতক ছিল।

আরো পড়ুন

ইউগারিট লিপি

ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত সিরিয়ার রাস – সামারা নামক একটি গ্রামের কবরস্থানে ১৯২০ সালে এই লিপির সন্ধান পাওয়া গেছে। সেখানে একটি পাথরে এই লিপি উৎকীর্ণ ছিল। এর বয়স অন্তত চার হাজার বছর। এই লিপি বাম থেকে ডান দিকে লেখা হত। বর্ণ সংখ্যা ৩২।

বিব্লশলিপি

হায়ারোগ্লিফিক লিপির অনুসরণে আর একটি ধ্বনিভিত্তিক লিপি। সিরিয়ার বিব্লশ শহরে, প্রাচীন রাজা আহিরামের সমাধি ফলকে এই লিপি খুঁজে পাওয়া যায়।

ফিনিশীয় লিপি

সিরিয়া ও প্যালেষ্টাইনের উত্তর পশ্চিমে ফিনিশিয়া নামে একটি ক্ষুদ্র দেশে প্রাচীন সেমেটিক জাতির বাস ছিল। এঁরা বিব্লশলিপির আদলে যে লিপিমালা তৈরী করেন তার নাম ফিনিশিয় লিপি। এর বর্ণ সংখ্যা ২২। সবগুলিই ব্যঞ্জনবর্ণ। স্বরবর্ণের ব্যবহার জানতেন না। ডেড সী বা মরু সাগরের তীরে এই লিপির নিদর্শন পাওয়া গেছে।

প্রোটো-সেমেটিক লিপি

ফিনিশিয়ায় প্রচলিত সেমেটিক লিপির অনুসরণে উন্নত গ্রিকরাই প্রথম সম্পূর্ণ বর্ণমালা তৈরী করেন। এই লিপি ধ্বনিনির্ভর লিপি। উচ্চারণের সঙ্গে মিল রেখে পূর্বেকার ১২টি ব্যঞ্জনের সঙ্গে এঁরাই ৫টি স্বরবর্ণের সংযুক্তি ঘটান। পৃথিবীতে প্রথম যে বর্ণমালা ব্যবহৃত হয় তা প্রোটো – সেমেটিক বর্ণমালা। সিরিয়া ও প্যালেস্তাইনের মানুষরাই এই বর্ণমালার আবিষ্কার ও প্রয়োগ করেন। এই বর্ণমালা আবিষ্কারের আনুমানিক সময় ১৭৩০ – ১৮৮০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ। প্রোটো – সেমেটিক বর্ণমালার সঙ্গে অন্যান্য উত্তর সেমেটিক যেমন আব্দো, শালাওবাল, আসদ্রবাল, অখিরাম, ইয়েখিমিল্ক, আবিলাল, এলিবাল, মোবাইট প্রভৃতি বর্ণমালার প্রচুর সাদৃশ্য রয়েছে। প্রোটো – সেমেটিক বর্ণমালাই পৃথিবীর প্রথম বর্ণমালা যেখানে লিপি কোনো ছবি বা ভাবের প্রকাশক নয়, তা একেবারে উচ্চারণভিত্তিক ধ্বনি লিপি।

আলোচক – সৌগত মুখোপাধ্যায়, সহকারী অধ্যাপক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *