চর্যাপদ – সরল গদ্যানুবাদ
আমরা এর আগে বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদের পাঁচটি পদের ব্যাখ্যা ও শব্দার্থের টীকাসহ একটি পোস্ট করেছি। সেই সরল অনুবাদ পোস্ট সকলের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আমরা এই পোস্টে আরও পাঁচটি চর্যার সরল গদ্যানুবাদ করেছি। চর্যাপদ – সরল গদ্যানুবাদ শীর্ষক এই আলোচনাটি বাংলা সাহিত্যের সকল স্তরের ছাত্রছাত্রীর তথা বাংলা সাহিত্য-রসিকের পছন্দ হবে। ৬ নং থেকে ১০ নং পদের গদ্যানুবাদ পেতে পড়ুন।
চর্যা – ৬ (রাগ – পটমঞ্জরী, পদকর্তা – ভুসুকু পা)
কাহেরে ঘিনি মেলি অচ্ছহু কীস।
বেঢ়িল হাক পড়অ চৌদীস ৷৷
অপণা মাংসে হরিণা বৈরী।
খনহ ন ছাড়অ ভুসুকু অহেরি ॥
তিণ না ছুপ্পই হরিণা পিবই ন পানী।
হরিণা হরিণীর নিলঅ ণ জানী ॥
হরিণী বোলঅ সুণ হরিণা তো।
এ বণ চ্ছাড়ী হোহু ভান্তো ॥
তরসঁন্তে হরিণার খুর ন দীসঅ।
ভুসুকু ভণই মূঢ়া হিঅহি ণ পইসঈ ॥
গদ্যানুবাদ – কাকে গ্রহণ করে এবং কাকে ত্যাগ করে কিসে আছ। বেড়া-হাঁক চতুর্দিকে পড়ছে। আপনার মাংসের জন্যে হরিণ নিজের বৈরী (শত্রু)। ভুসুকু ব্যাধ তাকে ক্ষণমাত্র ছাড়ে না। হরিণ তৃণ ছোঁয় না, জল পান করে না। হরিণ হরিণীর আবাসস্থল জানে না। হরিণী বলে হরিণকে ওহে হরিণ শুন। তুমি এই বন ছেড়ে ভ্রমণ কর। হরিণ ভয়ে এমন দ্রুত গতিতে চলে গেল যে তার খুর-সঞ্চালন দেখা যায় না। ভুসুকু বলেন, মূঢ়ের হৃদয় এর মর্ম প্রবেশ করে না।
চর্যা – ৭ (রাগ – পটমঞ্জরী, পদকর্তা – কাহ্ন পা)
আলিএঁ কালিএঁ বাট রুন্ধেলা।
তা দেখি কাহ্ন বিমন ভইলা ॥
কাহ্নু কহি গই করিব নিবাস।
জো মনোগোঅর সো উআস ॥
তে তিনি তে তিনি তিনি হো ভিন্না।
ভণই কাহ্নু ভব পরিচ্ছিন্না ॥
জে জে আইলা তে তে গেলা।
অবণাগবণে কাহ্নু বিমন ভইলা॥
হেরি সে বাহ্নি নিঅড়ি জিনউর বট্টই।
ভণই কাহ্নু মো হিঅহি ন পইসই॥
গদ্যানুবাদ – আলিতে কালিতে পথ রোধ করল। তা দেখে কাহ্ন বিমনা হলেন। কাহ্ন কোথায় গিয়ে বাস করবে। যে মনোগোচর সে উদাস (দূরে অবস্থান করে)। তাহারা তিন, তারা তিন এবং সে তিনও পরম্পর ভিন্ন (ভিন্নমতে – অভিন্ন)। কাহ্ন বলেন, এই ভব (চক্র] পরিচ্ছিন্ন (বিনষ্ট) কর। যারা যারা এল তারা তারা চলে গেল। আনাগোনায় কাহ্ন বিমন হলেন। দেখ দেখি সেই জিনপুর কাছেই আছে। কাহ্ন বলেন, আমার হৃদয়ে প্রবিষ্ট হচ্ছে না।
চর্যা – ৮ (রাগ – দেবক্রী, পদকর্তা – কম্বলাম্বর পা)
সোনে ভরিতী করুণা নাবী ॥
রূপা থোই নাহি কে ঠাবী ॥
বাহতু কামলি গঅণ উবেসেঁ।
গেলী জাম বহুড়ই কইসে ॥
খুন্টি উপাড়ী মেলিলি কাচ্ছি।
বাহ তু কামলি সদ্গুরু পুচ্ছি॥
মাঙ্গত চড়হিলে চউদিস চাহঅ।
কেড়ুয়াল নাহি কেঁ কি বাহবকে পারঅ॥
বাম দাহিন চাপী মিলি মিলি মাঙ্গা।
বাটত মিলিল মহাসুহ সঙ্গা ॥
গদ্যানুবাদ – করুণা রূপ নৌকা সোনায় পরিপূর্ণ। রূপো রাখবার জায়গা নেই। বাহ তুই কামলি গগনের উদ্দেশ্যে। গত জন্ম ফিরে আসে কি করে। খুঁটি উপড়ে কাছি খোলা হল। গুরুকে জিজ্ঞাসা করে বাহ তুই কামলি। মার্গে চড়লে চতুর্দিকে দেখ। কেড়ুয়াল নাই, কে কি করে বাইতে পারে। বাম ও দক্ষিণ চাপিয়া বিদায় মাগে। পথেই মিলল মহাসুখের সঙ্গ।
চর্যা – ৯ (রাগ – পটমঞ্জরী, পদকর্তা – কাহ্ন পা)
এবংকার দিঢ় বাখোড় মোড্ডিউ।
বিবিহ বিআপক বান্ধন তোড়িউ॥
কাহ্নু বিলসঅ আসব মাতা।
সহজ নলিনী বন পইসি নিবিতা॥
জিম জিম করিণা করিনিরে রিসঅ।
তিম তিম তথতা মঅগল বরিসঅ॥
ছড়গই সঅল সহাবে সূধ।
ভাবাভাব বলাগ ন ছুধ ॥
দশবল রঅণ হরিঅ দশদিসে।
অবিদ্যা করিকুঁ দম অকিলেসে ॥
গদ্যানুবাদ – দৃঢ় বন্ধনস্তম্ভ এবংকার মর্দিত করে এবং বিবিধ প্রকার ব্যাপক বন্ধন ছিন্ন করে আসবমত্ত কাহ্নু বিলাস করেন, এবং সহজরূপ পদ্মবনে প্রবেশ করে নিবৃত্তি লাভ করলেন। যেমন যেমন করে করী করিণীতে প্রেমাসক্ত হয়; তেমনি তেমনি তথতা মদধারা বর্ষণ করে। ষড়গতি-র প্রভাবে সকল স্বভাবে শুদ্ধ। ভাব এবং অভাব এতটুকু ক্ষুব্ধ নয়। দশবল রত্ন দশদিকে হৃত হয়েছে। অবিদ্যারূপ করীকে অক্লেশে দমন কর।
চর্যা – ১০ (রাগ – দেশাখ, পদকর্তা – কাহ্ন পা)
নগর বাহিরি রে’ ডোম্বী তোহোরি কুড়িআ।
ছোই ছোই জাই সো ব্রাহ্ম* নাড়িআ॥
আলো ডোম্বি তোএ সম করিব ম সাঙ্গ।
নিঘিণ কাহ্ন কাপালি জোই লাংগ।
এক সো পদমা চৌষঠী পাখুড়ী।
তহি চড়ি নাচঅ ডোম্বী বাপুড়ী॥
হা লো ডোম্বী তো পুছমি সদভাবে।
আইসসি জাসি ডোম্বী কাহারি নাবে।
তান্তি বিকণঅ ডোম্বী অবর না চাংগেরা’।
তোহোর অন্তরে ছাড়ি নড়পেড়া॥
তুলো ডোম্বী হাঁউ কপালী।
তোহোর অন্তরে মোএ ঘেনিলি হাড়েরি মালী॥
সরবর ভাঞ্জীঅ ডোম্বী খাঅ মোলাণ।
মারমি ডোম্বী লেমি পরাণ।
গদ্যানুবাদ – নগর-বাইরে ডোমনী, তোর কুঁড়ে। নাড়া ব্রাহ্মণকে (তুই) ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাস। ওরে ডোমনী, তোর সঙ্গে আমি সাঙ্গা করব। আমি কাহ্ন, কাপালিক যোগী নির্ঘণ এবং নাঙ্গা। এক সেই পদ্ম যার চৌষট্টি পাপড়ি। তার উপর চড়ে ডোমনী বাপুড়ী নৃত্য করে। ওরে ডোমনী, তোকে সদ্ভাবে জিজ্ঞাসা করি, কার নৌকায় তুই আসিস যাস। এখন ডোম্বী তাঁত বোনে, আর চাঙারী নয়। তোর জন্য নট-পেটিকা ত্যাগ করি। তুই ডোম্বী, আমি কাপালিক। তোর জন্য আমি হাড়ের মালা গ্রহণ করলাম। সরোবর ভেঙে ডোমনী মলান খায়। ডোমনীকে মেরে তার প্রাণ নিই।