বাংলা সাহিত্যসাময়িক পত্রিকা

কয়েকটি বিখ্যাত সাময়িক পত্রিকা এবং তার লেখকগোষ্ঠী

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সাময়িক পত্রিকা -এর অবদান কী তা বাঙালী পাঠক মাত্রেই জানেন। গদ্যের সূচনা ও পরিপুষ্টতায় তথা সামগ্রিক বাংলা সাহিত্যের বিবর্তনে এই সাময়িক পত্রিকা গুলির অবদান অনস্বীকার্য। আমাদের এই পোস্টে এমনই বেশ কিছু বাংলা সাময়িক পত্রিকা এবং তার লেখকগোষ্ঠীর পরিচয় দেওয়া হয়েছে।

সাময়িক পত্রিকা ও তার লেখকগোষ্ঠী

আমরা বিভিন্ন সাময়িক পত্রিকার নাম ও তাদের লেখকগোষ্ঠীর নাম ক্রমাণ্বয়ে আলোচনা করলাম। পোস্টটি ভালো লাগলে কমেন্ট করবেন।

তত্ত্ববোধিনী

রামমোহন রায়ের মৃত্যুর পর তার মতাদর্শে বিশ্বাসী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তত্ত্ববোধিনী সভা প্রতিষ্ঠা করেন।এই সভার মুখপত্র হিসেবে ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে এই পত্রিকা প্রকাশিত হয়। সম্পাদক ছিলেন অক্ষয়কুমার দত্ত। এই পত্রিকা বাংলা গদ্যকে এক সচ্ছন্দ গতি দিয়েছিল। শিক্ষিত মানুষের রুচি প্রসারে ঊনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্য মাধ্যমে পরিণত হয়েছিল।

লেখকগোষ্ঠি অক্ষয় কুমার দত্ত, নবীন চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, অযোধ্যানাথ পাকরাশি, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ এই পত্রিকায় লেখা দিয়াছিলেন।

বঙ্গদর্শন

বঙ্কিমচন্দ্র সম্পাদিত, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রথম উন্নত মানের যথার্থ সাহিত্য পত্রিকার মর্যাদা লাভ করে এই পত্রিকা।পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে ও মাতৃভাষাকে শিক্ষার বাহন হিসেবে তুলে ধরতে সচেষ্ট হয়েছিল এই পত্রিকা।

লেখকগোষ্ঠী – হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়,নবীনচন্দ্র সেন,রমেশ চন্দ্র দত্ত, কালীপ্রসন্ন ঘোষ, অক্ষয়চন্দ্র সরকার, মোহিতলাল মজুমদার, বঙ্কিমচন্দ্র, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ।

প্রবাসী

রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় এই মাসিক পত্রিকাটি ১৯০১ খ্রিঃ এলাহাবাদ থেকে প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের ‘প্রবাসী’ কবিতাটি ছাপা হয়। তৎকালীন নতুন সাহিত্যিক দের প্রতিভা, দেশি বিদেশি চিত্রকলা, রাজনীতি ও সমাজনীতি বিষয়ের আলোচনায় এই পত্রিকা মুখরিত হতো।

লেখকগোষ্ঠী – ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়, নীরদচন্দ্র চৌধুরী, গোপাল হালদার, সজনিকান্ত দাস, পুলিনবিহারি সেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।

ভারতবর্ষ

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সম্পাদনায় ভারতবর্ষ (সচিত্র) পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকা বাংলা সাহিত্যের উন্নতি সাধনে বিশেষ সক্রিয় ছিল। ভ্রমণমূলক রচনা প্রকাশের বিশেষ ঝোঁক ছিল।

লেখকগোষ্ঠী – জ্যোতির্ময়ী দেবী, মৃণালিনী সেন, উর্মিলা দেবী, জলধর সেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুভাষ চন্দ্র বসু, ধূর্জুটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, শিবরাম চক্রবর্তী, রাজশেখর বসু, প্রবোধ কুমার সান্যাল প্রমুখ।

সবুজপত্র

প্রমথ চৌধুরী এই পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন। মননশীলতা,প্রকাশভঙ্গি,বক্রতা, বৈদগ্ধ,বিজ্ঞান, দর্শন,সাহিত্য ইত্যাদি বিষয়ে এই পত্রিকা তৎকালীন বাঙ্গালী রসগ্রাহী দের খোরাক যুগিয়েছে।

লেখকগোষ্ঠী – প্রমথ চৌধুরী,  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অতুলচন্দ্র গুপ্ত, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী প্রমুখ

কল্লোল

বাংলা সাহিত্যের একটি বিশেষ কালকে কল্লোলের যুগ বলে চিহ্নিত করা হয়। গোকুল চন্দ্র নাগ ও দীনেশ চন্দ্র দাশ প্রথম এই মাসিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।এই পত্রিকাকে কেন্দ্র করে আধুনিক বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্র বিরোধী ধারার সূচনা হয়েছিল।বিদ্রোহ,প্রতিবাদ,ক্ষুধা,দারিদ্র্য,কামনা বাসনা,যৌনতা কল্লোলের সাহিত্য চর্চার প্রধান দিক ছিল।

লেখকগোষ্ঠী – অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, কাজী নজরুল ইসলাম, প্রেমেন্দ্র মিত্র, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, মনীশ ঘটক, বুদ্ধদেব বসু, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ।

বিচিত্রা

উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। বাংলা সাহিত্যের অভিজাত রুচিসম্পন্ন পত্রিকার আসন লাভ করেছিল। চিত্র ও অলঙ্করণ প্রকাশে বিশেষ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল এই পত্রিকা।তৎকালীন তরুণ নব্য লেখক দের বহু উচ্চমানের প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল এই পত্রিকায়।

লেখকগোষ্ঠী – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, সতীনাথ ভাদুড়ী, বিমল মিত্র, উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, অন্নদাশঙ্কর রায়, শশীভুষন দাসগুপ্ত

প্রগতি

বুদ্ধদেব বসু ও অজিত দত্তের যুগ্ম সম্পাদনায় ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়। আধুনিক ও বাস্তববাদী চিন্তা ধারা প্রকাশে অগ্রণী ভূমিকা দেখিয়ে ছিল। এই পত্রিকার একটি আকর্ষণীয় দিক ছিল বিভিন্ন গ্রন্থ সমালোচনা।

লেখকগোষ্ঠী – মনীশ ঘটক, জীবনানন্দ দাশ, কাজী নজরুল ইসলাম, মোহিতলাল মজুমদার, হেমচন্দ্র বাগচি, পরিমল রায়, বুদ্ধদেব বসু, অজিত দত্ত।

পরিচয়

এই পত্রিকাকে কেন্দ্র করে বাংলা সাহিত্যএর নতুন পথ উন্মোচিত হয়েছিল। ত্রিমাসিক এই পত্রিকাটি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সম্পাদনায় প্রথম প্রকাশিত হয়।বর্তমানে এই পত্রিকার সম্পাদক হলেন বিশ্ববন্ধু ভট্টাচার্য।পূর্ব বর্তী অন্যান্য সম্পাদক হলেন-হিরনকুমার সান্যাল,গোপাল হালদার,সুভাষ মুখোপাধ্যায়,মঙ্গলা চরণ চট্টোপাধ্যায়,মনিন্দ্র রায়,অমিতাভ দাসগুপ্ত প্রমুখ। সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা,বিদেশী চিন্তাধারা,মার্ক্সবাদী ও প্রগতিশীল সাহিত্য বিকাশে সক্রিয় হয়ে উঠেছিল।

লেখকগোষ্ঠী – ধূর্জুটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অন্নদাশঙ্কর রায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে

কবিতা

বুদ্ধদেব বসু ও প্রেমেন্দ্র মিত্রের যুগ্ম সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল। রবীন্দ্র প্রভাবমুক্ত লেখা প্রকাশে জোর দিয়েছিল। বিদ্রোহ, প্রতিবাদ,যৌনতা এই পত্রিকার সাহিত্য চর্চার প্রধান উপজীব্য ছিল।

লেখকগোষ্ঠী – বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সমর সেন, জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, প্রতিভা বসু, বাণী রায়।

শনিবারের চিঠি

সজনিকান্ত দাসের পরিচালনায় ও যোগানন্দ দাসের সম্পাদনায় প্রথম প্রকাশিত হয়।তরুণ সাহিত্যিক দের সাহিত্যকে ব্যঙ্গবানে বিদ্ধ করা ও প্রতিবাদ করাই এই পত্রিকার প্রধান উদ্দেশ্যে ছিল।কল্লোল কালের সবচেয়ে বিরোধী ও সতন্ত্র পত্রিকা ছিল এই পত্রিকাটি।

লেখকগোষ্ঠী – অশোক চট্টোপাধ্যায়, যোগানন্দ দাস, সজনিকান্ত দাস, পরিমল গোস্বামী, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ মৈত্র, মোহিতলাল মজুমদার, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজশেখর বসু, গোপাল হালদার প্রমুখ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *