কবি জয়দেব – অজানা কিছু তথ্য
কবি জয়দেব তাঁর সুমধুর গীতগোবিন্দ কাব্যের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। তাঁর লেখা পদ কাল থেকে কালান্তরে, যুগ থেকে যুগান্তরে সকল শ্রেণির পাঠকের হৃদয় হরণ করে নিয়েছে। আমাদের আজকের কবি জয়দেব – অজানা কিছু তথ্য শীর্ষক পোস্টে কবি সম্পর্কিত নানা তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। আশা করি এই লেখনী পাঠক পাঠিকার ভালো লাগবে। ভালো লাগলে কমেন্টে মতামত জানানোর অনুরোধ রইল। যুক্ত হোন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল প্রয়াসে।
কবি জয়দেব – সাধারণ পরিচয়
‘গীতগোবিন্দ’ রচয়িতা জয়দেব দ্বাদশ শতকে বীরভূম জেলায় অজয় নদ তীরস্থিত কেন্দুবিল্ব (বা কেঁদুলি) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কেউ কেউ তাঁকে মিথিলার আবার কেউ ওড়িশার কবি বলেন। কিন্তু বর্তমানে এইসব দাবি অমূলক প্রমাণিত হয়েছে। কবি জয়দেব তাঁর ‘গীতগোবিন্দে’র দ্বাদশ সর্গের ২৯ সংখ্যক শ্লোকে আত্মপরিচয় দিয়েছেন যা থেকে জানা যায়, তাঁর পিতার নাম ভোজদেব এবং মাতা বামাদেবী বা রামাদেবী। কবির প্রিয়বন্ধুর নাম পরাশর। আবার উক্ত কাব্যের প্রথম সর্গের দ্বিতীয় শ্লোকে আছে ‘পদ্মাবতীচরণচারণচক্রবর্তী’। দশম সর্গে তিনি লিখেছেন, ‘জয়তি পদ্মাবতীরমণজয়দেবকবি’। এইসব শ্লোক থেকে জানা যায় কবির পত্নীর নাম পদ্মাবতী।
গীতগোবিন্দ কথা
জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ দ্বাদশ সর্গে সমাপ্ত। সর্গগুলির নাম যথাক্রমে – ‘সামোদ-দামোদরঃ’, ‘অক্লেশ-কেশবঃ’, ‘মুগ্ধ-মধুসূদনঃ’, ‘স্নিগ্ধ-মধুসূদনঃ’, ‘সাকাঙ্খপুণ্ডরীকাক্ষঃ’, ‘ধৃষ্টবৈকুণ্ঠ’, ‘নাগর-নারায়ণঃ’, ‘বিলক্ষলক্ষ্মীপতিঃ’, ‘মুগ্ধ-মুকুন্দঃ’, ‘মুগ্ধ-মাধবঃ’, ‘সানন্দ-গোবিন্দঃ’ এবং ‘সুপ্রীত-পীতাম্বরঃ’। কাব্যে প্রধান চরিত্র তিনটি – রাধা, কৃষ্ণ ও সখী। মোট গানের সংখ্যা চব্বিশটি। সংখ্যায় সখীর গানই অধিক। তারপরে রাধা ও কৃষ্ণের গান মাত্র তিনটি। কাব্যটির সূচনা ‘মান’ দিয়ে আর সমাপ্তি ‘মিলন’ দিয়ে। ‘গীতগোবিন্দে’র গায়েন ছিলেন কবি-বন্ধু পরাশর।
অনুবাদ
জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ এদেশের বাইরেও বিশেষ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। উইলিয়ম জোন্স প্রথম ইংরেজিতে এই কাব্যের অনুবাদ করেন। ‘গীতগোবিন্দে’র ইংরেজি অনুবাদ করেছেন এডুইন আর্নল্ডও। F.H Vandalberg জার্মান ভাষায় ‘গীতগোবিন্দে’র অনুবাদ করেছিলেন। ভাষাতাত্ত্বিক prof. Mayrhofer ‘গীতগোবিন্দ’কে সংস্কৃত সাহিত্যের প্রতিনিধি স্থানীয় গ্রন্থের একটি বলে উল্লেখ করেছেন। বার্নাড কলেজের অধ্যাপিকা Barbara Stoler Miller ‘Jayadeva’s Gitagovinda: Love Song of the Dark Lord’ নামে গ্রন্থ রচনা করেন।
মূল্যায়ন
বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিশিষ্টজনে ‘গীতগোবিন্দ’ সম্পর্কে তাঁদের মতামত প্রকাশ করেছেন। বিদ্যাসাগর তাঁর ‘সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্যশাস্ত্র বিষয়ক প্রস্তাব’ গ্রন্থে লিখেছেন – ‘এরূপ ললিত পদবিন্যাস, শ্রবণ-মনোহর অনুপ্রাসচ্ছটা ও প্রসাদগুণ প্রায় কুত্রাপি লক্ষিত হয় না।’ রমেশচন্দ্র দত্ত লিখেছেন, ‘এই বাঙালী কবির হস্তে সংস্কৃত ভাষা তাহার সমস্ত প্রকার ধাতবকাঠিন্য ত্যাগ করিয়া যেন ইতালীয় ভাস্কর্যের কোমলতা লাভ করিয়াছে।’ বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৩০০ বঙ্গাব্দে ‘সাধনা’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘জয়দেব’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘এই গীতগোবিন্দ-এ গীত থাকিতে পারে, কিন্তু গোবিন্দ আছেন কিনা আমাদের সম্পূর্ণ সন্দেহ আছে। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ১৩৫০ বঙ্গাব্দে ভারতবর্ষ পত্রিকায় ‘শ্রীজয়দেব কবি’ প্রবন্ধে জয়দেব সম্পর্কে বলেছেন, ‘সংস্কৃত ভাষায় সর্বাপেক্ষা শ্রুতিমধুর গীতিকবিতার কবি।’ আধুনিক কবি বুদ্ধদেব বসুর মতে, ‘জয়দেব ভারতীয় সাহিত্যে প্রাচীনের অস্তরাগ এবং আধুনিকের পূর্বরাগ।’