নির্মিতি

সারাংশ লিখন – নিয়ম ও উদাহরণ

বাংলায় ‘সারাংশ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয় ইংরেজি ‘Precis’ শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে। ল্যাটিন ‘Praecisus’ শব্দের অর্থ হল কোনো কিছুকে সংক্ষিপ্ত করা। ইংরেজির ‘Precis’ বাংলায় সারাংশ, সারমর্ম, সারসংক্ষেপ, সংক্ষিপ্ত সার, ভাবার্থ ও মর্মার্থ হিসেবে প্রচলিত আছে। সারাংশ লিখন -এর উদ্দেশ্য লিখনের দক্ষতা ও স্বকীয়তার মান যাচাই করা।

সারাংশ লিখনের মধ্য দিয়ে সাধারণভাবে কোনো গদ্যাংশ বা পদ্যাংশের মূল বক্তব্যটি জানতে চাওয়া হয়। তাহলে কাকে বলে সারাংশ লিখন ? সহজভাবে বললে, কোনো রচনার মূল বক্তব্যকে সহজ-সরল ভাবে প্রকাশ করার পদ্ধতিই হল সারাংশ লিখন। প্রতিবেদন কেমন করে লিখতে হয় জানতে দেখুন

সারাংশ লিখন – নিয়ম

১. আদর্শ সারাংশ লেখার জন্য প্রদত্ত অনুচ্ছেদটি (গদ্যাংশ বা পদ্যাংশ) মনোযোগ সহকারে পড়তে হবে এবং অনুচ্ছেদের মূল বক্তব্যটি অনুধাবন করতে হবে। প্রয়োজনে অনুচ্ছেদটি একাধিকবার পড়তে হবে।

২. মূল বক্তব্যটি প্রদত্ত অনুচ্ছেদের এক-তৃতীয়াংশের মধ্যে লিখতে হবে। কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রে মূল ভাবটি লিখতে হয়। এক্ষেত্রে এক-তৃতীয়াংশের মতো কোনো শর্ত থাকে না।

৩. সারাংশ লিখতে হবে চলিত ভাষায়। যদি অনুচ্ছেদটি সাধুভাষায় দেওয়া থাকে তাহলে সারাংশ লিখনের সময় তা চলিত ভাষায় রূপান্তরিত করতে হবে।

৪. সারাংশের ভাষা হবে সহজ-সরল। তবে বক্তব্যে শিল্পগুণ বজায় রাখতে হবে।

৫. প্রদত্ত অনুচ্ছেদ থেকে কোনো শব্দ নেওয়া যেতে পারে, কিন্তু কোনো বাক্য হুবহু নেওয়া যাবে না।

৬. সারাংশ লিখনের সময় স্মরণে রাখতে হবে যাতে মূল বক্তব্য উপস্থাপনের সময় নতুন কোনো যুক্তি বা তথ্যের অবতারণা না হয়।

আমাদের ব্যাকরণ অ্যাপ ডাউনলোড করুন

৭. সারাংশের সূচনা হবে অনুচ্ছেদের মূল বক্তব্য কেন্দ্রিক।

৮. অনুচ্ছেদের প্রত্যক্ষ উক্তি সারাংশে পরোক্ষ উক্তি হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।

৯. অনুচ্ছেদের কোনো উক্তি সংলাপধর্মী হলে তা সারাংশে বিবৃতি আকারে উপস্থাপন করতে হবে।

১০. অনুচ্ছেদে উদ্ধৃতি চিহ্নের মাধ্যমে কোনো বক্তব্য পরিবেশিত হলে তা সারাংশে বক্তব্যের মূল ভাব হিসেবে লিখতে হবে। এক্ষেত্রে উদ্ধৃতি চিহ্ন তুলে দিতে হবে। মনে রাখুন, সারাংশ লেখার সময় কোনো উদ্ধৃতি চিহ্ন ব্যবহার করা যাবে না।

১১. সারাংশের সূচনায় ‘উদ্ধৃত অংশে কবি বলেছেন’ জাতীয় কিছু লেখা যাবে না।

১২. অনুচ্ছেদে উপমা, রূপক প্রভৃতি অলঙ্কারের ব্যবহার হলেও সারাংশ লিখনে কেবল তার মূল বক্তব্যটি উল্লেখ করতে হবে।

১৩. সারাংশ লিখনের জন্য পরীক্ষায় কোনো রচনা থেকে একাধিক অনুচ্ছেদ দেওয়া হতে পারে। আপনাকে উত্তর করতে হবে একটিমাত্র অনুচ্ছেদেই।

১৪. অনুচ্ছেদের দীর্ঘ বাক্যকে ছোটো বাক্যে এবং একাধিক পদকে সমাসবদ্ধ পদে পরিণত করে যথাসম্ভব সংহত ভাবে লিখতে হবে।

১৫. সারাংশ লিখনে একই বক্তব্যের পুনরুক্তি বর্জন করতে হবে।

১৬. অনেক সময় পরীক্ষায় সারাংশ লিখতে একটি ছক-কাটা কাগজ দেওয়া হয়। তাতে উত্তর করার সময় প্রতিটি ঘরে একটি করে শব্দ লিখতে হয়। এক্ষেত্রে কোন কোন শব্দ একসঙ্গে হয়, আর কোনগুলি পৃথক তা জানতে হবে।

আদর্শ সারাংশের উদাহরণ

১. ভয় মানুষের অবধারিত শত্রু। সে তাহার সুদৃঢ় ভিত্তিকে দুর্বল করিয়া সাধন করে তাহার চরম সর্বনাশ। ভয়হীনতাই শক্তি। আত্মশক্তিতে বিশ্বাসী হইয়া ভয়কে জয় করিতে হইবে। “শক্তি মরে ভীতির কবলে।” সেই শক্তিকে ভীতির কবলমুক্ত করিয়া ভয়কে পদদলিত করিয়া ঋজু মেরুদণ্ড লইয়া এই পৃথিবীতে যথার্থ মানুষের মতো বাঁচিতে হইবে। নিশ্চেষ্ট ও পরনির্ভর হইয়া বাঁচিয়া থাকার চেয়ে মৃত্যুও শ্রেয়। সেই মৃত্যুতেও আছে গৌরব। যাহারা ভীরু, ভয়ের গুহায় যাহারা সারাজীবন আত্মগোপন করিয়া থাকে, যাহারা মৃত্যুর পূর্বে বহুবার মরে, তাহারা মানবতার কলঙ্ক। মানুষ তাহাদের প্রতি শ্রদ্ধাহীন, ইতিহাস তাহাদের সম্পর্কে কঠিনভাবে নীরব, ঘৃণা ও বিকৃত জীবনই তাহাদের শ্রেষ্ঠ পুরষ্কার।

২. জ্ঞান মানুষের মধ্যে সকলের চেয়ে বড়ো ঐক্য সাধন করে। বাংলাদেশের এক কোণে যে ছেলে পড়াশুনা করিয়াছে তার সঙ্গে য়ুরোপ-প্রান্তের শিক্ষিত মানুষের মিল অনেক বেশি সত্য, তার দুয়ারের পাশে মুর্খ প্রতিবেশীর চেয়ে।

জ্ঞানে মানুষের সঙ্গে মানুষের এই যে জগৎজোড়া মিল বাহির হইয়া পড়ে, যে মিল দেশভেদ কালভেদকে ছাড়াইয়া যায়–সেই মিলের পরম প্রয়োজনের কথা ছাড়িয়া দেওয়া যাক। কিন্তু সেই মিলের যে পরম আনন্দ তাহা হইতে কোনো মানুষকে কোনো কারণেই বঞ্চিত করিবার কথা মনেই করা যায় না।

সেই জ্ঞানের প্রদীপ এই ভারতবর্ষ কত বহু দূরে দূরে এবং কত মিট্‌মিট্‌ করিয়া জ্বলিতেছে, সে কথা ভাবিয়া দেখিলেই বুঝিতে পারি ভারতবাসীর পক্ষে সেই পরম যোগের পথ কত সংকীর্ণ–যে যোগ জ্ঞানের যোগে, যে যোগে সমস্ত পৃথিবীর লোক আজ মিলিত হইবার সাধনা করিতেছে।

আলোচক – নীলরতন চট্টোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *