প্রতিবেদন রচনা – নিয়ম ও শ্রেণিবিন্যাস
বাংলায় প্রতিবেদন শব্দটি ব্যবহৃত হয় ইংরেজি ‘Report’ শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে। কোনো ঘটনার সহজবোধ্য প্রকাশ অর্থে ‘Report’ শব্দটি প্রযুক্ত হয়। বাংলাতেও ‘প্রতিবেদন’ বলতে বোঝায় কোনো ঘটনার প্রকৃত বিবরণী। প্রতিবেদন রচনা – নিয়ম ও শ্রেণিবিন্যাস শীর্ষক এই পোস্টে প্রতিবেদন কী, তা লেখার নিয়ম এবং বিভিন্ন শ্রেণির প্রতিবেদন সম্পর্কে আলোচিত হয়েছে। দেওয়া হয়েছে একটি আদর্শ প্রতিবেদনের নমুনা।
সদ্য ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনাকে সকলের কাছে সহজ-সাধ্য ভাবে যথাসম্ভব সরল ভাষায় তুলে ধরাই প্রতিবেদনের মুখ্য উদ্দেশ্য। যিনি প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন তাকে প্রতিবেদক বলা হয়। খেলাধুলা, শিক্ষা, লোকসেবা, রাজনীতি, দুর্ঘটনা, মৃত্যু, কৃষি, শিল্প ইত্যাদি যেকোনো বিষয় নিয়েই প্রতিবেদন লেখা যেতে পারে।
প্রতিবেদন রচনা – প্রতিবেদনের শ্রেণিবিন্যাস
সমস্ত বিষয় অনুসারে প্রতিবেদনকে কয়েকটি সাধারণ শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যেমন –
১. সংবাদভিত্তিক প্রতিবেদন (সংবাদপত্রের প্রতিবেদন)
২. সম্পাদকীয় প্রতিবেদন
৩. ক্রীড়া প্রতিবেদন
৪. সাক্ষাৎকার ভিত্তিক প্রতিবেদন
তবে পরীক্ষায় প্রথম দুই শ্রেণির প্রতিবেদনই লিখতে দেওয়া হয়। সেজন্য আমরা এই দুই প্রকার প্রতিবেদন নিয়েই আলোচনা করব।
প্রতিবেদন রচনা – নিয়ম
১. সংবাদভিত্তিক প্রতিবেদন রচনা
কোনো ঘটনাকে সংবাদের আকারে সকল শ্রেণির মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য এই প্রকার প্রতিবেদন লেখা হয়। সংবাদভিত্তিক প্রতিবেদন রচনার সময় যে মস্ত নিয়ম মেনে লিখতে হয় তা নীচে উল্লেখ করা হল।
ক. এই প্রকার প্রতিবেদনে প্রথমেই একটি শিরোনাম থাকতে হবে। শিরোনামটি হবে সংক্ষিপ্ত এবং যথাসম্ভব আকর্ষণীয় যা থেকে পাঠক সহজেই প্রতিবেদনের বিষয় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেতে পারে।
খ. শিরোনামের পর প্রতিবেদনের সূচনায় প্রতিবেদকের পরিচয়, স্থান ও প্রতিবেদন রচনার দিনাঙ্ক উল্লেখ করতে হবে। তবে অবশ্য স্মরণীয় যে, দিনাঙ্ক কখনওই পরীক্ষার দিনটি হবে না।
গ. প্রতিবেদকের পরিচয়, স্থান ও প্রতিবেদন রচনার দিনাঙ্ক উল্লেখের পরের অংশটি হল প্রতিবেদনের মুখ্য সূচনা অংশ। এই অংশে প্রতিবেদনের মূল বিষয়টি থাকবে। মনে রাখবেন, মূল বিষয়টি উপস্থাপিত হবে কমবেশি ৫০টি শব্দে।
ঘ. সূচনা অংশে মূল বিষয়টি উপস্থাপনের পর আসে প্রতিবেদনের ব্যাখ্যা অংশ যা কখনও একটি বা একাধিক অনুচ্ছেদে লেখা হয়। এই অংশের বিষয় উপস্থাপনে ১০০ থেকে ১১০টি শব্দ খরচ করা যেতে পারে।
আরও দেখুন
ঙ. এরপর প্রতিবেদনের সমাপ্তি অংশে থাকে সংশ্লিষ্ট ঘটনার প্রভাব। অর্থাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনাটি সমাজ ও মানুষের চেতনায় কী প্রভাব ফেলেছে তার উল্লেখ।
চ. যেহেতু এই ধরনের প্রতিবেদন সকল শ্রেণির মানুষের জন্য লেখা হয় তাই এর ভাষা হবে সহজ-সরল।
ছ. প্রচলিত শব্দের ব্যবহার করতে হবে। ইংরেজি শব্দের ব্যবহার করলে তা বাংলা হরফে করতে হবে।
জ. সংবাদ পরিবেশন করতে হবে নিরপেক্ষ ভাবে।
ঝ. প্রতিবেদনের ভাষা হবে চলিত। সাধু ও চলিতের মিশ্রণ যাতে না ঘটে সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে।
ঞ. বানানের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। প্রতিবেদনে ভুল বানান প্রয়োগ করা যাবে না।
ট. প্রতিবেদনের বিষয় উপস্থাপনে যাতে ঘটে যাওয়া ঘটনারই কেবল সঠিক বর্ণণা প্রাধান্য পায় তা সুনিশ্চিত করতে হবে।
ঠ. প্রতিবেদন রচনার সময় যথাযথ বিরাম চিহ্নের ব্যবহার আবশ্যিক।
ড. মনে রাখুন, অনেকক্ষেত্রে পরীক্ষায় প্রতিবেদন লিখতে দেওয়ার সময় কিছু সূত্র দেওয়া হয়। সেসব ক্ষেত্রে প্রদত্ত সূত্র মেনে প্রতিবেদনটি লিখতে হবে।
২. সম্পাদকীয় প্রতিবেদন রচনা
কোনো বিশেষ ঘটনা, ব্যক্তিত্ব ইত্যাদি সম্পর্কে পাঠককে অবগত করাতে এই প্রকার প্রতিবেদন লেখা হয়। সম্পাদকীয় প্রতিবেদন লিখতে কিছু বিশেষ নিয়ম মেনে চলতে হয়। এই প্রকার প্রতিবেদনের নির্দিষ্ট নিয়মগুলি নীচে উল্লেখ করা হল –
ক. সম্পাদকীয় প্রতিবেদনের শিরোনামটি হতে হবে বুদ্ধিদীপ্ত। শিরোনাম থেকেই যাতে রচনার মূল বক্তব্য বোঝা যায় তা নিশ্চিত করতে হবে। এই শিরোনাম হতে পারে ব্যঞ্জনাধর্মী, বক্তব্য কেন্দ্রিক অথবা ব্যঙ্গাত্মক।
খ. এই প্রকার প্রতিবেদন লেখার সময় প্রতিবেদক হিসেবে নিজস্ব সংবাদদাতা এবং প্রতিবেদন লেখার স্থান ও কালের উল্লেখ থাকে না।
গ. এই প্রকার প্রতিবেদনে বক্তব্য বিষয়ের গভীরতা থাকে।
ঘ. সম্পাদকীয় প্রতিবেদন সর্বমোট কমবেশি ২০০ শব্দের মধ্যে লিখতে হয়।
ঙ. এই প্রতিবেদন লিখতে দুটি বা তিনটি অনুচ্ছেদ ব্যবহার করা যেতে পারে।
আরও দেখুন
চ. যদি কোনো উদ্ধৃতি বা প্রবাদ-প্রবচনের উল্লেখ করতে হয় তবে তা বাংলা হরফেই ব্যবহার করতে হবে।
ছ. সম্পাদকীয় প্রতিবেদনে কোনো ঘটনা বা তথ্যের সমালোচনা থাকে।
জ. ভাষা হবে সহজ কিন্তু তার মধ্যে মার্জিত, চিন্তার গভীরতা থাকবে। সাধু ও চলিতের মিশ্রণ যাতে না ঘটে সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে।
ঝ. বানানের প্রতি যত্নশীল থাকতে হবে। আধুনিক প্রচলিত বানান ব্যবহার করতে হবে।
ঞ. যথাযথ বিরাম চিহ্নের প্রয়োগ করতে হবে।
ট. সম্পাদকীয় প্রতিবেদন কোনো বক্তব্যের স্বপক্ষে বা বিপক্ষে লেখা যায়। তবে প্রতি ক্ষেত্রেই যুক্তি থাকা বাঞ্ছনীয়।
আদর্শ প্রতিবেদনের উদাহরণ
ম্যানহোলে পড়ে গিয়ে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে — এই বিষয় অবলম্বনে সংবাদপত্রের একটি প্রতিবেদন রচনা করুন।
ম্যানহোলে পড়ে শিশুর মৃত্যু, এলাকায় চাঞ্চল্য
নিজস্ব সংবাদদাতা, বর্ধমান, ২৫শে ডিসেম্বরঃ রাস্তায় খোলা থাকা ম্যানহোলে পড়ে এক শিশুর মৃত্যু হল বর্ধমান শহরে। মৃত শিশুর নাম পলাশ মাইতি (৮)। ঘটনায় প্রকাশ, বর্ধমান শহরের তিনকোনিয়া বাসস্ট্যাণ্ডের নিকট মূল রাস্তার ওপর জলনিকাশী বেশ কয়েকটি ম্যানহোল আছে। তারই একটি খোলা থাকায় শিশুটি ঐ ম্যানহোলে পড়ে যায় এবং তার মৃত্যু হয়।
এ ঘটনা জানাজানি হতেই এলাকায় রীতিমত চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে। শিশুটির পরিবার সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সন্ধ্যের সময় স্থানীয় দোকান থেকে চিনি কিনতে বের হয় শিশুটি। তারপর দীর্ঘক্ষণ বাড়ি না ফেরায় পরিবারের সকলে তার সন্ধান করতে শুরু করে। এদিক-ওদিক অনেক অনুসন্ধানের পর মৃত পলাশের প্রতিবেশী দিবাকর সাহা ম্যানহোলে টর্চ জ্বেলে দেখতে পান একটি শিশু নিথর হয়ে পড়ে রয়েছে। সকলের চেষ্টায় তাকে উদ্ধার করার পর নিয়ে যাওয়া হয় বর্ধমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
রাস্তায় খোলা পড়ে থাকা ম্যানহোল নিয়ে স্থানীয়দের ক্ষোভ অনেকদিনের। স্থানীয় বাসিন্দা শ্যামলকান্তি রায় জানান, ‘আমরা বহুবার প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি; কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।’ যদিও এই ঘটনার পর প্রশাসন সূত্রে আশ্বাস দিয়ে বলা হয়েছে যত দ্রুত সম্ভব খোলা ম্যানহোল বন্ধ করা হবে এবং মৃত শিশুর পরিবারকে কিছু আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। কোনো আর্থিক সাহায্য সন্তানহারা ঐ পরিবারের কোন ক্ষতি পূরণ করবে এই প্রশ্ন পরিবার ও প্রতিবেশীদের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে।
আর একটি উদাহরণ
শব্দবাজি নিষিদ্ধ করা হোক – এ বিষয়ে একটি সম্পাদকীয় প্রতিবেদন রচনা করুন।
নিষিদ্ধ হোক শব্দবাজি
কবির ভাষায় ‘ফুল ফোটে ? তাই বল, আমি ভাবি পটকা।’ এখন নিশ্চিন্তে কান পেতে ফুল ফোটার শব্দ শোনার উপায় নেই। পটকার আওয়াজ কেবল ভাবনার স্তরেই আছে তা নয়, তা আমাদের আজ অতিষ্ট করে তুলেছে। বিপর্যস্ত করে তুলেছেন দৈনন্দিন জীবন। তাই সচেতন মানুষেরা রব তুলেছেন, নিষিদ্ধ হোক শব্দবাজি।
মানুষের ওঠা এই রব অসঙ্গত নয়। বর্তমান পরিস্থিতি এমনই যে, সামান্য কিছু অনুষ্ঠানেই এখন ফাটানো হচ্ছে শব্দবাজি। বিশেষত এই প্রবণতা অধিক লক্ষ্য করা যায় দীপাবলিতে। তাতে সামিল হয়েছে চিন থেকে আমদানি করা শব্দ-বৈচিত্র্যে ভরপুর রঙ-বেরঙের বাজি। মানুষকে আনন্দ দিতে গিয়ে নিরানন্দ হয়ে উঠছে সকলের জীবন। বলা বাহুল্য, শব্দবাজির নানাবিধ শব্দ শিশু এবং বয়স্কদের মধ্যে অধিক প্রভাব ফেলছে। চিকিৎসকেরা বলেন, ইদানিং নাকি কানে শুনতে না পাওয়ার রোগ বেশিই আসছে। এমনকি শিশুদের মধ্যেও এই রোগের প্রবণতা বাড়ছে। শুধু কি শব্দের কু-প্রভাব ? তা নয়। বাজি ফাটানোর পর যে ধোঁয়া বের হয় তাও পরিবেশ তথা মানব-শরীরের পক্ষে বিপজ্জনক। এর ফলে মানুষের মধ্যে ফুসফুসের রোগ বাড়ছে। বিনষ্ট হচ্ছে বাতাসের বিশুদ্ধতা।
তাই পরিবেশ ও মানুষের স্বার্থেই নিষিদ্ধ হওয়া উচিত শব্দবাজি। একান্ত প্রয়োজনে শব্দের একটি নির্দিষ্ট মাত্রা বেঁধে দিতে হবে। প্রয়োজনে পুলিশকে ব্যবহার করতে হবে ‘সাউন্ড লেভেল মিটার।’ বাজি পোড়ানোরও একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া উচিত। প্রশাসনকে শক্ত হাতে অবশ্যই বিষয়টিতে নজর দিতে হবে। তা না হলে বাসযোগ্য একমাত্র এই ধরাভূমি ক্রমে বিনষ্ট হয়ে যাবে।