সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত – জীবন ও সাহিত্য
বাংলা কাব্যধারায় কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত -এর স্থান চিরস্থায়ী হয়ে আছে। তাঁর ছন্দ-বৈচিত্র্যময় কবিতা অধিক পরিমাণে পাঠকচিত্তকে দোলা দিয়ে যায়। বাঙালি পাঠকের কাছে তিনি ‘ছন্দের যাদুকর’। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত – জীবন ও সাহিত্য আমাদের এই পোস্টে কবির জীবন ও সাহিত্য বিষয়ে কিছু আলোকপাত করার প্রয়াসী আমরা। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বিষয়ে মক টেস্ট দিন এই লিঙ্কে ক্লিক করে।
জন্ম ও বংশ পরিচয়
কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত -এর জন্ম ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের ১২ই ফেব্রুয়ারি চব্বিশ পরগণার নিমতায়, তাঁর মাতুলালয়ে। কবির পিতার নাম রজনীনাথ দত্ত এবং মাতার নাম মহামায়া দেবী। ‘প্রবাসী’ পত্রিকায়, শ্রাবণ ১৩২৯ বঙ্গাব্দে কবির মামা কালীচরণ মিত্রের একটি লেখা থেকে জানা যায়, কবির জন্মের দিন প্রবল ঝড়-বাদল হয় বলে তাঁকে ‘ঝড়ি’ বলে ডাকা হত। কিন্তু স্বভাবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত শান্ত প্রকৃতির।
কবির বংশ পরিচয়ে জানা যায় তাঁরা ছিলেন কায়স্থ পরিবারের সন্তান। কবির পূর্বপুরুষ রাজবল্লভ দত্ত টাকী সন্নিকটস্থ গন্ধর্বপুর গ্রাম থেকে নবদ্বীপের অদূরে চুপী গ্রামে চলে আসেন এবং বসবাস শুরু করেন। রাজবল্লভের এক পুত্র রামশরণ। রামশরণের পুত্র পীতাম্বর। পীতাম্বরের পুত্র অক্ষয়কুমার দত্ত। অক্ষয়কুমারের তিন পুত্রের একজন রজনীনাথ। এই রজনীনাথের পুত্র কবি সত্যেন্দ্রনাথ।
শৈশব ও শিক্ষাজীবন
কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত -এর শৈশব কাটে দাদু-ঠাকুমার স্নেহের মধ্য দিয়ে। কিন্তু কবির চার বছর বয়সে পিতামহ অক্ষয়কুমার দত্ত মারা যান। তখন ঠাকুমার কাছেই তাঁর যত আদর। তাঁর মুখে নানা কাহিনি ও ছড়া শুনে শুনে বেড়ে ওঠেন কবি। এরপর ধীরে ধীরে শুরু হয় তাঁর ছাত্রাবস্থা।
১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে কবি ভর্তি হন সেন্ট্রাল কলেজিয়েট স্কুলে। ১৮৯৯ খ্রিঃ এই স্কুল থেকে দ্বিতীয় বিভাগে এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাশ করেন। এরপর ঐ বছর জেনারেল অ্যাসেমব্লিজ ইনস্টিটিউশনে এফ.এ ক্লাসে ভর্তি হন। এফ.এ পড়াকালীনই তাঁর ‘সবিতা’ কাব্যের প্রকাশ। ১৯০৩ খ্রিঃ সত্যেন্দ্রনাথ বি.এ পরীক্ষা দেন কিন্তু অকৃতকার্য হন।
দাম্পত্যসঙ্গী
বি.এ পড়ার সময় কবির পিতৃবিয়োগ হয়। কিন্তু পুত্রের বিবাহের পাত্রী তিনি পূর্বেই স্থির করে ফেলেছিলেন। সেই হিসেবে ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দের ১৭ এপ্রিল হাবড়া-নিবাসী ঈশানচন্দ্র বসুর কন্যা কনকলতা দেবীর সঙ্গে সত্যেন্দ্রনাথের বিবাহ হয়।
সঙ্গীতপ্রেম
সঙ্গীতের প্রতি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ছিল প্রগাঢ় ভালবাসা। জানা যায়, স্কুলে পড়ার সময় থেকেই তাঁর গানের প্রতি অনুরাগ জন্মায়। গানের চর্চাও করতেন তিনি। শুধু গান গাওয়া নয়, গান রচনাও করেছেন তিনি। তাঁর ‘কোন্ দেশেতে তরুলতা সকল দেশের চাইতে শ্যামল’ গানটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। প্রেমের গান, হোলির গান, ফুলের গান নানা ধরনের গান লিখে গেছেন সত্যেন্দ্রনাথ।
সাহিত্য চর্চা
আমরা আগেই বলেছি, এফ.এ পড়ার সময়ই কবির ‘সবিতা’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। তবে প্রথম প্রকাশের সময় তাতে কবির নাম ছিল না। এই কাব্যটি পড়ে কবির শিক্ষক তথা বিখ্যাত নাট্যকার ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ কবিকে বলেছিলেন, ‘তোমার কবিতা বেশ লেখা হয়েছে।’ তিনি কবিকে আরও অভ্যাসের পরামর্শও দেন।
যদিও এর বহু পূর্বে ‘হিতৈষী’ পত্রিকায় কবির ‘মধুপুরের সংবাদ’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়। সময়কাল ১৩০২ বঙ্গাব্দ। কিন্তু পুরোপুরি কবি হিসেবে সত্যেন্দ্রনাথের আবির্ভাব সুরেশচন্দ্র সমাজপতির ‘সাহিত্য’ পত্রিকায়। এই পত্রিকায় ‘দেখিবে কি’ কবিতাটি প্রকাশিত হয় ফাল্গুন ১৩০৮ বঙ্গাব্দে।
‘ভারতী’ পত্রিকায় কবির বিভিন্ন কবিতা প্রকাশিত হতে শুরু করে ১৩১৬ সাল থেকে। পরে এই পত্রিকার তিনি নিয়মিত লেখক হয়ে ওঠেন। ঐ বছরেই ‘প্রবাসী’তেও তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়। ১৩২১ সালে ‘সবুজপত্র’ পত্রিকায় তাঁর ‘সবুজ পাতার গান’ কবিতাটি মুদ্রিত হয়। তবে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন মূলত ‘ভারতী’ ও ‘প্রবাসীর’ লেখক।
শুধু কবিতাই নয়, সত্যেন্দ্রনাথ উপন্যাস, নাটক এবং অনুবাদেও আপন দক্ষতা দেখিয়েছেন। তাঁর জন্মদুঃখী’ (১৯১২), চীনের ধূপ (১৯১২), রঙ্গমল্লী (১৯১৩), বারোয়ারী (১৯২১), ধূপের ধোঁয়া (১৯২৯) তারই সাক্ষ্য দেয়। একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘ডঙ্কা নিশানে’র রচনা শুরু করলেও তা অসমাপ্ত থেকে যায়।
কাব্যগ্রন্থের তালিকাঃ সবিতা (১৯০০), সন্ধিক্ষণ (১৯০৫), বেণু ও বীণা (১৯০৫), হোমশিখা (১৯০৭), তীর্থরেণু (১৯১০), ফুলের ফসল (১৯১১), কুহু ও কেকা (১৯১২), মণিমঞ্জুষা (১৯১৫), অভ্র আবীর (১৯১৬), হসন্তিকা (১৯১৭), বেলা শেষের গান (১৯২৩), বিদায় আরতি (১৯২৪)
ছান্দসিক সত্যেন্দ্রনাথ
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকে কেবল কবি হিসেবে মূল্যায়ন করলে ভুল হবে। তিনি দক্ষ ছান্দসিকের মতো বাংলা ছন্দ নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। প্রথম দিকে মাত্রাবৃত্ত ছন্দ নিয়ে কবিতা লিখলেও পরে স্বরবৃত্ত ছন্দই তাঁকে অধিক টেনেছিল। তাঁর কথায় স্বরবৃত্ত ছন্দ হল ‘বাংলা ভাষার প্রাণ পাখি।’ তাঁর ব্যবহৃত ছন্দের একটি নমুনা –
হাড় বেরুনো খেজুরগুলো
ডাইনি যেন ঝামর-চুলো
নাচতেছিল সন্ধ্যাগমে,
লোক দেখে কি থমকে গেল ?
শেষ জীবন
সত্যেন্দ্রনাথ শারীরিকভাবে কোনো সময়ই ভালো ছিলেন না। ক্রমে তাঁর দৃষ্টিশক্তি কমে আসতে শুরু করেছিল। এ সময়ে তিনি মুখে বলে যেতেন কবিতা, অন্যজন লিখে নিতেন। এইভাবে চলতে চলতে একদিন তিনি জ্বরে আক্রান্ত হন। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ২৫শে জুন তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন –
‘সত্যেন্দ্র আমার বহু পরে আসিয়াও অগ্রে অনিন্দিত নন্দনের রাজ্যে চলিয়া গেলেন—সত্য সুন্দরের সাক্ষাৎ পাইলেন, দৃষ্টির আড়াল তাঁহার খসিয়া গেল, আর আমি এখানে পড়িয়া রহিলাম।’
শেষ কথা
মাত্র চল্লিশ বছরের জীবনে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবি-জীবন কেবল পনের বছর। এই অল্প সময়ের সাহিত্য জীবনে তিনি বাংলা সাহিত্যকে উপহার দিয়েছেন নানা স্বাদের কবিতা। তাঁর কবিতায় বিচিত্র ছন্দের ব্যবহার বাঙালি পাঠককে করেছে নন্দিত। তাঁর কবিতায় ধরা পড়েছে প্রকৃতির বিচিত্র রূপ।