বাংলার চিত্রকলার ইতিহাসে রামকিঙ্কর বেইজ এর অবদান
শান্তিনিকেতনকে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ শিল্পচর্চা কেন্দ্রে রূপান্তরিত করেছিলেন রামকিঙ্কর বেইজ , তাদের মধ্যে অন্যতম।
শিল্পী হিসেবে তার একটি দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। বিশেষ এক লক্ষ্য নিয়ে তিনি শিল্পচর্চা করতেন। চিরকুমার রামকিঙ্কর অত্যন্ত নির্মোহ ও খেয়ালি জীবনযাপন করতেন। তার সৃষ্টিকর্মে প্রকৃতি ও প্রান্তিক মানুষের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।
রামকিঙ্কর বেইজ – জন্ম ও বংশ পরিচয়
১৯০৬ সালের ২৫ মে তিনি বাঁকুড়ার জুগিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।তাকে অনেকে আদিবাসী মনে করলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি তা নন। দলিত ও আদিবাসীদের জীবন নিয়ে ব্যাপক শিল্প সৃষ্টির জন্য তার সম্পর্কে মানুষের এই ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তার বেইজ পদবি সংস্কৃত বৈদ্য ও প্রাকৃত বেজ্জ-এর মিলিত রূপ। তিনি এক পরামাণিক পরিবারের সন্তান। কিন্তু ১৯২৫ সালে তার পরিবার ওই পদবি পরিত্যাগ করেন।
রামকিঙ্কর বেইজের অবদান
শৈশবে বাঁকুড়ার কুমোরদের কাজ দেখে তিনি বড় হয়েছেন। তাদের দেখাদেখি কাদা দিয়ে মূর্তি গড়েছেন। এভাবেই ভাস্কর্য শিল্পের প্রতি তার আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। স্বশিক্ষিত শিল্পী বলতে যা বোঝায় রামকিঙ্কর বেইজ ছিলেন তাই। ১৯২৫ সালে ‘প্রবাসী’র সম্পাদক রমানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের প্রচেষ্টায় তিনি বিশ্বভারতীর কলাভবনে ভর্তি হন। সেখানে নন্দলাল বসু ও রবীন্দ্রনাথের তত্ত্বাবধানে তার শিল্পশিক্ষা বিশেষ মাত্রা লাভ করে। অধ্যয়ন শেষে তিনি ১৯৩০ সালে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কলাভবনে যোগ দেন। শান্তিনিকেতনকে যারা গুরুত্বপূর্ণ শিল্পচর্চা কেন্দ্রে রূপান্তরিত করেছিলেন রামকিঙ্কর বেইজ, নন্দলাল বসু ও বিনোদবিহারী মুখার্জী তাদের অন্যতম। শিল্পী হিসেবে তার একটি দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। বিশেষ এক লক্ষ্য নিয়ে তিনি শিল্পচর্চা করতেন। চিরকুমার রামকিঙ্কর অত্যন্ত নির্মোহ ও খেয়ালি জীবনযাপন করতেন। তার সৃষ্টিকর্মে প্রকৃতি ও প্রান্তিক মানুষের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।
তিনি প্রতীচ্যের শিল্পভাষাকে আত্মস্থ করে তার সৃষ্টিকর্মে ব্যবহার করেছিলেন। ভারতীয় শিল্পকলার আধুনিকতার পুরোগামী শিল্পী হিসেবে তাকে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। তিনি এমন এক সময় শিল্প নির্মাণ শুরু করেন যখন ভারতীয় শিল্পকলা ক্রমান্বয়ে আধুনিকতার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। তাই তার শিল্পকর্ম ভারতীয় শিল্প-ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত। প্রথমদিকে রামকিঙ্কর ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা অসহযোগ আন্দোলনের সংগ্রামীদের আবক্ষ চিত্র আঁকতেন। মানুষের মুখ, অভিব্যক্তি, তাদের শরীরের ভাষা নাটকীয় ভঙ্গিতে প্রকাশ করাতে তার আগ্রহ ছিল বেশি। আধুনিক পাশ্চাত্য শিল্প, প্রাচীন ও আধুনিক ভারতীয় ধ্ররুপদী চিত্রকর্ম তার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। বিষ্ণুপুর মন্দিরের টেরাকোটা ভাস্কর্য দ্বারা তিনি বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। টেরাকোটা রিলিফ ও পাথর খোদাইয়ের পাশাপাশি তিনি জল ও তেলরঙে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন। শিল্প নির্মাণে তিনি দেশজ উপাদানের প্রাধান্য দিতেন এবং একইসাথে একজন মডেল ও তক্ষণশিল্পীর দক্ষতা ব্যবহার করতেন। তার ভাস্কর্য গতি ও প্রাণপ্রাচুর্যের আধার। ভাস্কর্যের বিমূর্ত রূপরীতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষাকারী প্রথম ভারতীয় শিল্পী ছিলেন রামকিঙ্কর।
আরও পড়ুন
তার ভাস্কর্য গতিশীল, ছান্দিক ও প্রতিসম যার সাথে প্রকৃতির একটি আত্মিক যোগাযোগ খুঁজে পাওয়া যায়। ভারতীয় ভাস্কর্যের চারিত্র্য নির্মাণে রামকিঙ্করের বিশেষ ভূমিকা অনস্বীকার্য। তিনি তার শিল্পকর্মে সাঁওতালদের জীবন ও কর্মের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন পাশ্চাত্য প্রকাশবাদী ঢঙে। তার ভাস্কর্য ও চিত্রকলার কোনোটিই তার সময়ের প্রচলিত ভারতীয় রূপরীতির অনুসারী নয়। সেগুলো তার নিজস্ব ভাবনার ঋদ্ধ প্রকাশ। শহরের আকর্ষণ ছেড়ে দূরে উত্তর কলকাতায় শান্তিনিকেতনে কাটিয়েছেন প্রায় সারাটা জীবন। ওখানকার ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষরা তার আগ্রহ কেড়ে নিয়েছিল। ছবি ও ভাস্কর্যে তিনি তাদের জীবনকে ধরে রাখতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। তার চারপাশে সচল, প্রাণবন্ত মৃত্তিকালগ্ন এই জীবন-প্রবাহ তাকে সার্বক্ষণিক টানতো। প্রকৃতির সৌন্দর্য ও তার দানবীয় শক্তি উভয়ই তিনি তার শিল্পকর্মে ভিন্নমাত্রায় তুলে ধরেছেন। তাইতো তার ছবিতে দেখতে পাই ধানমাড়াইরত গ্রামীণ নারী, সাঁওতাল উৎসব, বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা এবং ঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিশেষ বৈশিষ্ট্য নিয়ে চিত্রিত। শিল্পী কে জি সুব্রামনিয়াম তার সম্পর্কে বলেছেন-
[quote]‘সম্ভবত তিনি প্রথম ভারতীয় ভাস্কর যাকে সৃষ্টিশীল ভাস্করের খেতাব দেয়া যায়, তিনি ফরমায়েশকারীর চাহিদা মেটাতে নয় বরং নিজের আনন্দের জন্য ভাস্কর্য নির্মাণ করতেন।’[/quote]
উন্মুক্ত ভাস্কর্য নির্মাণে তিনি সব সময় সিমেন্ট ও পাথর ব্যবহার করতেন, কারণ আর কোনো উপাদান ব্যবহার করার সঙ্গতি তার ছিল না। তিনি অত্যন্ত দক্ষতা ও দ্রুততার সাথে উপাদানকে মিশিয়ে কাক্সিক্ষত আদল নির্মাণ করতেন। ‘কবি’ শিরোনামে ব্রোঞ্জে করা একটি বিমূর্ত আবক্ষ ভাস্কর্য তার নিজস্ব ভাবনার নতুনত্ব তুলে ধরে। তার বড় ভাস্কর্যগুলোর প্রায় সবই শান্তিনিকেতনে সংরক্ষিত রয়েছে। তার মধ্যে ‘সাঁওতাল পরিবার’ অন্যতম।
মূল্যায়ন
রামকিঙ্কর বেইজ ভারতরত্ন পাননি, পাওয়ার যোগ্য ছিলেন কিনা এটা এদেশে বিতর্কের বিষয়। ভারত সরকার এখন মরণোত্তর ভারতরত্ন দেওয়ার পক্ষেও সওয়াল করছেন বলে, অবহেলা অনাদরে মরণপ্রাপ্ত কীর্তিমান ভারতীয়দের কেউ কেউ ভারতরত্নের জন্য স্মরণযোগ্য হয়ে উঠছেন। এই প্রসঙ্গ তোলার তাগিদের কারণ, আমাদের এই অনেক প্রাচীন দেশের অফুরন্ত শিল্প ভাস্কর্যের ভাণ্ডার — যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ঈর্ষনীয় হলেও এখনও পর্যন্ত কোনও শিল্পীর ভাগ্যে জোটাতে পারেনি ভারতরত্নের শিরোপা। পরিহাসটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন অধিকাংশ বিদেশী পর্যটকের ভারত ভ্রমণের উদ্দেশ্য ও কারণ খোঁজা হয়। আমাদের দেশে কোনও ভেনিস বা সিঙ্গাপুর নেই যে বিদেশিরা শুধু শহর দর্শনেই আসতে পারেন। তাঁদের আসার অন্যতম তাগিদ থাকে আমাদের দেশের চিত্র, ভাস্কর্য ও স্থাপত্যশিল্পের ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা স্মারক নিদর্শনের তথ্য সন্ধান ও তাদের সান্নিধ্যলাভ।পরিশেষে বলা যায়, রামকিঙ্কর ছিলেন প্রথম ভারতীয় শিল্পী যিনি আধুনিক পাশ্চাত্য শিল্প অধ্যয়ন করে সেই শৈলী নিজের ভাস্কর্যে প্রয়োগ করেন। তাঁকে ভারতীয় শিল্পে আধুনিকতার জনক ও অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী মনে করা হয়।
আলোচক – কুতুব আলী, রায়গঞ্জ।