বাংলা সাহিত্যবৈষ্ণব পদাবলি

বিদ্যাপতির পদাবলী

আমাদের আজকের উপস্থাপনায় রয়েছে বৈষ্ণব পদাবলী। এই পোস্টে আমরা বিদ্যাপতি রচিত বিভিন্ন পর্যায়ের পদাবলী তুলে ধরেছি। এতে আশা করা যায়, পাঠক পাঠিকা তথা ছাত্রছাত্রীদের অনেক উপকার হবে। বিদ্যাপতির পদাবলী পোস্টটি যদি ভালো লাগে তবে শেয়ার করুন। আর অবশ্যই আপনার মতামত জানান কমেন্ট বক্সে।

বিদ্যাপতির পদাবলী – প্রার্থনা পর্যায়

মাধব, বহুত মিনতি করি তোয়।
দেই তুলসী তিল            এ দেহ সমর্পিলুঁ
দয়া জনু ছোড়বি মোয়।।
গণইতে দোষ              গুণ-লেশ না পাওবি
যব তুহু করবি বিচার।
তুহুঁ জগন্নাথ জগতে কহায়সি
জগ বাহির নহ মুঞি ছার।।
কিয়ে মানুষ পশু পাখী কিয়ে জনমিয়ে
অথবা কীট পতঙ্গ।
করম-বিপাকে গতাগতি পুন পুন
মতি রহু তুয়া পরসঙ্গ।।
ভণয়ে বিদ্যাপতি অতিশয় কাতর
তরইতে ইহ ভবসিন্ধু।
তুয়া পদপল্লব করি অবলম্বন
তিল এক দেহ দীনবন্ধু।।

তাতল সৈকত বারিবিন্দু সম
সুত-মিত-রমণী-সমাজে।
তোহে বিসরি’ মন তাহে সমর্পিলু
অব মঝু হব কোন কাজে।।
মাধব, হাম পরিণাম নিরাশা।
তুহু জগ-তারণ, দীন-দয়াময়,
অতয়ে তোহারি বিশোয়াসা।।
আধ জনম হাম নিন্দে গোঙায়লু,
জরা শিশু কতদিন গেলা।
নিধুবনে রমণী- রসরঙ্গে মাতলু
তোহে ভজব কোন বেলা।।
কত চতুরানন, মরি মরি যাওত
ন তুয়া আদি অবসানা।
তোহে জনমি’ পুন, তোহে সমাওত,
সাগর-লহরী সমানা।।
ভণয়ে বিদ্যাপতি, শেষ শমন-ভয়
তুয়া বিনু গতি নাহি আরা।
আদি-অনাদিক- নাথ কহায়সি,
অব তারণ- ভার তোহারা।

জতনে জতেক ধন পাপে বটোরলুঁ
মেলি পরিজনে খায়।
মরনক বেরি হেরি কোঈ ন পূছত
করম সঙ্গ চলি জায়।
এ হরি বন্দোঁ তুঅ পদ নায়।
তুঅ পদ পরিহরি পাপ-পয়োনিধি
পার হব কৌন উপায় ৷৷
জাবত জনম হম তুঅ পদ ন সেবিলুঁ
জুবতী মতিময় মেলি।
অমৃত তেজি কিয়ে হলাহল পীয়लूँ
সম্পদে বিপদহি ভেলি ৷৷
ভনহঁ বিদ্যাপতি লেহ মনে গনি
কহিলে কি জানি হয়ে কাজে।
সাঁঝক বেরি সেব কোই মাগই
হেরইতে তুঅ পদ লাজে।।

মাথুর পর্যায়

অঙ্কুর তপন- তাপে যদি জারব
কি করব বারিদ মেহে।
এ নব যৌবন বিরহে গোঙায়ব
কি করব সো পিয়া-লেহে।।
হরি হরি কো ইহ দৈব দুরাশা।
সিন্ধু নিকটে যদি কণ্ঠ শুকায়ব
কো দূর করব পিয়াসা।।
চন্দন-তরু যব সৌরভ ছোড়ব
শশধর বরিখব আগি।
চিন্তামণি যব নিজগুণ ছোড়ব
কি মোর করম অভাগি।।
শ্রাবণ মাহ ঘন বিন্দু না বরিখব
সুরতরু বাঁঝকি ছন্দে।
গিরিধর সেবি ঠাম নাহি পাওব
বিদ্যাপতি রহু ধন্ধে।।

অব মথুরাপুর মাধব গেল।
গোকুল-মাণিক কো হরি নেল।।
গোকুলে উছলল করুণাক রোল।
নয়ন-জলে দেখ বহয়ে হিলোল।।
শূন ভেল মন্দির শূন ভেল নগরী।
শূন ভেল দশ দিশ শূন ভেল সগরি।।
কৈছনে যায়ব যমুনা-তীর।
কৈছে নেহারব কুঞ্জ-কুটীর।।
সহচরী সঞে যাঁহা কয়ল ফুল-খেরি।
কৈছনে জীয়ব তাহি নেহারি।।
বিদ্যাপতি কহে কর অবধান।
কৌতুকে ছাপি তঁহি রহু কান।।

হরি গেও মধুপুর হাম কুলবালা।
বিপথে পড়ল যৈছে মালতী-মালা।।
কি কহসি কি পুছসি শুন প্রিয় সজনী।
কৈছনে বঞ্চব ইহ দিন-রজনী।।
নয়নক নিন্দ গেও বয়নক হাস।
সুখ গেও পিয়া-সঙ্গ দুখ হাম পাশ।।
ভণয়ে বিদ্যাপতি শুন বরনারী।
সুজনক কু-দিন দিবস দুই-চারি।।

চির চন্দন উরে হার না দেলা।
সো অব নদী-গিরি আঁতর ভেলা।।
পিয়াক গরবে হাম কাহুক না গণলা।
সো পিয়া বিনা মোহে কে কি না কহলা।।
বড় দুখ রহল মরমে।
পিয়া বিছুরল যদি কি আর জীবনে।।
পূরব জনমে বিহি লিখিল ভরমে।
পিয়াক দোখ নাহি যে ছিল করমে।।
আন অনুরাগে পিয়া আন দেশে গেলা।
পিয়া বিনে পাঁজর ঝাঁঝর ভেলা।।
ভণয়ে বিদ্যাপতি শুন বরনারী।
ধৈরজ ধরহ চিতে মিলব মুরারি।।

এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর
এ ভরা বাদর মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর
ঝম্পি ঘন গর- জন্তি সন্ততি
ভুবন ভরি বরিখন্তিয়া।
কান্ত পাহুন কাম দারুণ
সঘনে খর শর হন্তিয়া
কুলিশ শত শত পাত-মোদিত
ময়ূর নাচত মাতিয়া।
মত্ত দাদুরী ডাকে ডাহুকী
ফাটি যাওত ছাতিয়া।।
তিমির দিগ ভরি ঘোর যামিনী
অথির বিজুরিক পাঁতিয়া।
বিদ্যাপতি কহ কৈছে গোঙায়বি
হরি বিনে দিন রাতিয়া।।

ভাবোল্লাস ও মিলন – বিদ্যাপতির পদাবলী

পিয়া যব আওব এ মঝু গেহে।
মঙ্গল যতহুঁ করব নিজ দেহে।।
বেদী করব হাম আপন অঙ্গনে।
ঝাঞ্জু করব তাহে চিকুর বিছানে।।
আলিপনা দেওব মোতিম হার।
মঙ্গল-কলস করব কুচভার।।
কদলী-রোপব হাম গুরুয়া নিতম্ব।
আম্র-পল্লব তাহে কিঙ্কিণি সুঝম্প।।
দিশি দিশি আনব কামিনী-ঠাট।
চৌদিগে পসারব চাঁদক হাট।।
বিদ্যাপতি কহ পূরব আশ।
দুই-এক পলকে মিলব তুয়া পাশ।।

আজু রজনী হাম ভাগে পোহায়লুঁ
পেখলুঁ পিয়া-মুখ-চন্দাূ
জীবন-যৌবন সফল করি মানলুঁ
দশ দিশ ভেল নিরদন্দা।।
আজু মঝু গেহ গেহ করি মানলু
আজু মঝু দেহ ভেল দেহা।
আজু বিহি মোহে অনুকূল হোেয়ল
টুটল সবহঁ সন্দেহা।।
সোই কোকিল অব লাখ লাখ ডাকউ
লাখ উদয় করু চন্দা।
পাঁচবাণ অব লাখ বাণ হোউ
মলয় পবন বহু মন্দা।।
অব মঝু যব পিয়া সঙ্গ হোয়ত
তবহুঁ মানব নিজ দেহা।
বিদ্যাপতি কহ অলপ ভাগি নহ
ধনি ধনি তুয়া নব লেহা।।

কি কহব রে সখি আনন্দ ওর।
চিরদিনে মাধব মন্দিরে মোর।।
পাপ সুধাকর যত দুখ দেল।
পিয়া-মুখ-দরশনে তত সুখ ভেল।।
আঁচর ভরিয়া যদি মহানিধি পাই।
তব হাম পিয়া দূর দেশে না পাঠাই।।
শীতের ওঢ়নী পিয়া গীরিষির বা।
বরিষার ছত্র পিয়া দরিয়ার না।।
ভণয়ে বিদ্যাপতি শুন বরনারি।
সুজনক দুখ দিবস দুই-চারি।।

পূর্বরাগ পর্যায়

হাথক দরপণ মাথক ফুল।
নয়নক অঞ্জন মুখক তাম্বুল।।
হৃদয়ক মৃগমদ গীমক হার।
দেহক সরবস গেহক সার।।
পাখীক পাখ মীনক পানি।
জীবক জীবন হাম ঐছে জানি।।
তুহু কৈছে মাধব কহ তুহু মোয়।
বিদ্যাপতি কহ দুহুঁ দোহাঁ হোয়।

নহাই উঠল তীরে রাই কমলমুখী
সমুখে হেরল বর কান।
গুরুজন সঙ্গে লাজে ধনি নতমুখী
কৈসনে হেরব বয়ান।।
সখি হে, অপরূপ চাতুরী গোরী।
সব জন তেজি অগুসরি সঞ্চরি
আড় বদন তঁহি ফেরি।।
তঁহি পুন মোতি-হার তোড়ি ফেকল
কহত হার টুটি গেল।
সব জন এক এক চুনি সঞ্চরু
শ্যাম-দরশ ধনি লেল।।
নয়ন-চকোর কাহ্নু-মুখ-শশিবর
ক-এল অমিয়-রস-পান।
দুহুঁ দুহু দরশনে রসহু পসারল
কবি বিদ্যাপতি ভান।।

অবনত আনন কএ হম রহলিহুঁ
বারল লোচন-চোর।
পিয়া-মুখ-রুচি পিবএ ধাওল
জনি সে চাঁদ চকোর।।
ততহুঁ সাঞো হঠে হটি মোঞে আনল
ধএল চরণ রাখি।
মধুপ মাতল উড়এ ন পারও
তইঅও পসারএ পাঁখি।।
মাধব বোলল মধুর বাণী
সে শুনি মৃদু মোঞে কাল।
তাহি অবসর ঠাম বাম ভেল
ধরি ধনু পাঁচবাণ।।
তনু-পসেবে পসাহনি ভাসলি
পুলক তৈসন জাগু।
চুনি চুনি ভএ কাঁচুঅ ফাটলি
বাহু-বলয়া ভাগু।।
ভণ বিদ্যাপতি কম্পিত কর হো
বোলল বোল না যায়।
রাজা শিবসিংহ রূপনারায়ণ
শ্যামসুন্দর – কায়।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *