নাটক ও থিয়েটারবাংলা সাহিত্য

বাংলা নাট্য সাহিত্যের জনক হেরাসিম লেবেডেফ

বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে পাশ্চাত্য মডেলে তৈরি রঙ্গমঞ্চে প্রথম যে নাটকটি অভিনীত হয় সেটি একটি অনূদিত নাটক। অনুবাদক বাংলা এমনকি ভারতবর্ষেরও কেও নন, তিনি হলেন একজন রুশদেশীয় পরিব্রাজক ও বেহালাবাদক -নাম হেরাসিম লেবেডেফ Herasim Stephanovich Lebedev (১৭৪৯-১৮১৮)। নিম্নে তাঁর সম্বন্ধে সংক্ষেপে অলোচনা করা হল –

ভাগ্যান্বেষী ও ভারতীয় ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে আগ্রহী লেবেডেফ ১৭৮৫ খ্রিষ্টাব্দে ভারতবর্ষে আসেন। কলকাতায় উপস্থিত হয়ে লেবেডেফ বাংলা ভাষা সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। গোলকনাথ দাসের কাছ থেকে তিনি বাংলা ভাষা শেখেন। কলকাতার ২৫ নম্বর ডোমটোলায়(বর্তমানে ৩৭-৩৯ নম্বর এজরা স্ট্রিট) তিনি জগন্নাথ গাঙ্গুলী মহাশয়ের বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেখানে নিজের উদ্যোগে “দি বেঙ্গলী থিয়েটার” (The Bengally Theatre) গড়ে তোলেন। এই থিয়েটারেই প্রথম অনূদিত বাংলা নাটকের অভিনয় হয়।বাংলার সংস্কৃতি সম্পর্কে আগ্রহী লেবেডেফ বাংলা নাটকের অভিনয়ের জন্য সচেষ্ট হন। তিনি দুটি ইংরাজী নাটকের বাংলা অনুবাদ করেন।

১.মলিয়ের “Love is the Best Doctor”।
২.রিচার্ড পল জড্রেল -এর “The Disguise”–এর বাংলা রূপান্তরের নাম দিলেন “কাল্পনিক সংবদল”।

কাল্পনিক সংবদল – কিছু কথা

“The Disguise” এর বাংলা অনুবাদ “কাল্পনিক সংবদল” নাটকটি “দি বেঙ্গলী থিয়েটার” এ দু’বার অভিনীত হয়। প্রথম বার ১৭৯৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ নভেম্বর,দ্বিতীয় বার ১৭৯৬ খ্রিষ্টাব্দের ২১ মার্চ। “Love is the Best Doctor” এর অনুদিত রূপটি অভিনীত হয়নি। লেবেডেফ ইংরাজী ও রুশীয় নাট্যশালার মিশ্রণে “দি বেঙ্গলী থিয়েটার” তৈরী করেন। তিনি নিজেই মঞ্চ ও প্রেক্ষাগৃহের নক্সা তৈরী করেন। লেবেডেফ তাঁর অনূদিত “কাল্পনিক সংবদল” নাটকটি বাঙালী অভিনেতা-অভিনেত্রী দিয়ে অভিনয় করার পরিকল্পনা করেন।এই ব্যাপারে তাঁর বাংলা শিক্ষক গোলকনাথ দাস তাকে সহায়তা করেন। গোলকনাথ তখনকার ঝুমুরের দল থেকে ১০ জন পুরুষ অভিনেতা ও ৩ জন মহিলা অভিনেত্রী জোগাড় করেন। “The Disguise” –এর বাংলা অনুবাদ “কাল্পনিক সংবদল” নাটকটি মদনমোহন গোস্বামীর সম্পাদনায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। “কাল্পনিক সংবদল” নাটকটি Comedy of intrigue বা ষড়যন্ত্রমূলক রঙ্গপরিহাসের নাটক।

সংগীত জগতের সঙ্গে যুক্ত লেবেডেফ “কাল্পনিক সংবদল” নাটকে ভারতচন্দ্র রায়ের দুটি গান ব্যবহার করেছিলেন—-
১. “প্রাণ কেমন রে করে না দেখে তাহারে / যে করে আমার প্রাণ কহিব কাহারে।”
২. “গুণসাগর নাগর রায় / নগর দেখিয়া যায়।”

এই নাটকে লেবেডেফ মূল নাটকের চরিত্র ও স্থানের নামের বঙ্গ রুচি অনুযায়ী পরিবর্তন ঘটান — Lewis>ভোলানাথ(নায়ক) Clara>সুখময়ী(নায়িকা) Barnardo>রামসন্তোষ
স্থাননাম- Seville> কলকাতা Madrid>লক্ষ্নৌ

“কাল্পনিক সংবদল” নাটকটির প্রথম অভিনয়ে (২৭ নভেম্বর,১৭৯৫) দর্শক সংখ্যা ছিল ২০০। দ্বিতীয় অভিনয়ে(২১ মার্চ,১৭৯৬) দর্শক সংখ্যা বেড়ে হয় ৩০০। দর্শনী ছিল এক মোহর।

রুশদেশীয় লেবেডেফের এই সাফল্যে তৎকালীন ইংরেজদের “ক্যালকাটা থিয়েটার” কর্তৃপক্ষ খুবই বিচলিত হয়ে পড়ে। এই “ক্যালকাটা থিয়েটার” কর্তৃপক্ষের চক্রান্তে “দি বেঙ্গলী থিয়েটার” ভস্মীভূত হয়ে যায় মে, ১৭৯৭ খ্রিষ্টাব্দে। এই ভাবে লেবেডেফের বাংলা নাট্য প্রচেষ্টা শেষ হয়।

লেবেডেফের নাট্য প্রচেষ্টার ব্যর্থতার কারন –

লেবেডেফের নাটকের ভাষার দুরূহতা,দুর্বোধ্যতা ও আড়ষ্টতা সাধারণ বাঙালী জনসমাজের পক্ষে সহজবোধ্য ছিল না। বাঙালীর উৎসাহ ও রুচির সঙ্গে এর যোগ ছিল না। এই জন্য কোন কোন সমালোচক তার নাট্য প্রচেষ্টাকে পরবর্তী বাঙালীর নাট্য প্রচেষ্টার সঙ্গে যুক্ত করতে চাননি। লেবেডেফ বাঙালী জাতির মধ্যো নাট্যবোধ বা উৎসাহ জাগ্রত করতে পারেননি। তার নাট্য প্রচেষ্টার ব্যর্থতার কারন গুলি হল –

১. লেবেডেফের “দি বেঙ্গলী থিয়েটার” ক্ষণস্থায়ী। এখানে একটি মাত্র নাটক দু’বার অভিনীত হয়।
২.প্রবেশ মূল্য সাধারণের পক্ষে ক্ষমতারিক্ত ছিল।
৩.তাঁর সময় এদেশে ইংরাজী শিক্ষা চালু হয়নি। ইংরাজী শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আবির্ভাব তখনও হয়নি। বাঙালীর পরবর্তী নাট্য প্রচেষ্টার বিকাশে এই ইংরাজী শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালীর ভূমিকা ছিল সর্বাগ্রগণ্য।
৪. বণিক ইংরেজদের চক্রান্ত।

লেবেডেফের নাট্য প্রচেষ্টার সার্থকতা –

১. লেবেডেফের “দি বেঙ্গলী থিয়েটার” প্রথম বঙ্গীয় নাট্যশালা। ইংরেজ ও রুশ থিয়েটারের মিশ্রণে এই রঙ্গালয় গঠিত হয়ে ছিল। লেবেডেফ বঙ্গীয় নাট্যশালার জনক।
২. লেবেডেফের অনূদিত “কাল্পনিক সংবদল” নাটকটি “অধিকাংশ বাংলায় লিখিত” নাটকের প্রথম অভিনয়। উৎকৃষ্ট না হলেও প্রথম।
৩.সমস্ত চরিত্রে বাঙালী অভিনেতা-অভিনেত্রী দিয়ে নাট্যাভিনয়।
৪.বাঙালীর নাট্যাভিনয়ে প্রথম নারী ভূমিকায় অভিনেত্রীদের আবির্ভাব।
৫. ইংরেজদেরই নিজেদের থিয়েটার হতে পারে, বাঙালীর হতে পারে না –এই হীনমন্যতা বোধ থেকে তিনি বাঙালী নাট্যরসিকদের মুক্তি দিয়েছিলেন।

শুভাশিষ ঘোষঅ্যাডমিন, টার্গেট এসএসসি বাংলা

তথ্যসূত্রঃ
১.”বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত” (সপ্তম খণ্ড) -অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
২. “বাংলা থিয়েটারের ইতিহাস “ – দর্শন চৌধুরী।