অনুবাদ সাহিত্যের নানা কথা
বাংলা সাহিত্যে অনুবাদ সাহিত্যের ধারা বিশেষ ভাবে উল্লেখ যোগ্য। প্রথমেই আলোচনা করব রামায়ণ অনুবাদ নিয়ে। আমরা এই ধারাকে মূলত দুটি ভাগে ভাগ করতে পারি। চৈতন্য পূর্ব ও চৈতন্য পরবর্তী । প্রথম ভাগে যার নাম স্মরণীয় তিনি হলেন কৃত্তিবাস ওঝা।
রামায়ণ অনুবাদক কৃত্তিবাস ওঝার জন্ম চতুর্দশ শতকের শেষ দিকে আনুমানিক ১৩৮৬ – ১৩৯৮ খ্রি। জন্ম স্থান নদীয়ার ফুলিয়া গ্রামে।
বংশ পরিচয় – ওঝা উপাধিকারী ব্রাহ্মণ বংশে জন্ম। পিতার নাম বনমালী ওঝা, মাতার নাম মালিনী দেবী
জন্ম ক্ষণ – কোন এক মাঘ মাসে শ্রী পঞ্চমী তিথিতে রবিবারে। কবি জানিয়েছেন –
‘আদিত্যবার শ্রী পঞ্চমী পূর্ণ মাঘ মাস / তথি মধ্যে জন্ম লইলাম কৃত্তিবাস’
কাব্যের নাম – শ্রী রাম পাঁচালী
কাব্য রচনাকাল – পঞ্চদশ শতকের প্রথম দিকে আনুমানিক ১৪১৮ খ্রি।
কবির কাব্যে মূল রামায়ণের যে অংশ বর্জিত – কার্তিকের জন্ম, বিশ্বামিত্র কথা, লঙ্কা যুদ্ধের পর রাম সীতার তিক্ত বাক্য বিনিময়
কবি যা সংযোজন করেছেন – কৈকেয়ীর বর লাভ, গণেশের জন্ম, হনুমানের সূর্য ধারণ, তরণী সেন বৃত্তান্ত
কাব্যের প্রথম মুদ্রণ – উইলিয়ম কেরীর উদ্যোগে ১৮০২ – ০৩ খ্রি শ্রী রামপুর মিশন থেকে ।
কাব্যের কাণ্ড – ৭টি। আদি, অযোধ্যা, অরণ্য, কিষ্কিন্ধ্যা , সুন্দর, লঙ্কা ও উত্তর
কাব্যে মোট শ্লোক – ২৪০০০
এরপর আমরা দেখে নেব চৈতন্য পরবর্তী রামায়ণ অনুবাদকদের পরিচয়। এক্ষেত্রে প্রথমেই যার কথা বলতে হয় তিনি হলেন অদ্ভুতাচার্য।
রামায়ণ অনুবাদক অদ্ভুতাচার্য –
পিতৃদত্ত নাম নিত্যানন্দ আচার্য । পিতার নাম শ্রী নিবাস আচার্য । মাতার নাম মেনকা দেবী। কবির আবির্ভাব কাল নিয়ে নানা মত পার্থক্য আছে। মতভেদ আছে তার কাব্য রচনাকাল নিয়েও। কেননা এ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য পাওয়া যায় না। তবে ষোড়শ শতকের শেষ ভাগ তাঁর সময়কাল এমন একটা মোটামুটি সিদ্ধান্ত করেছেন গবেষকেরা ।
তাঁর কাব্য মূলত বাল্মীকি অনুসারী। রচনায় সংস্কৃত অদ্ভুত রামায়ণ, বাশিস্ট রামায়ণ, অধ্যাত্ম রামায়নের ঊপকরণ আছে।
প্রকাশ – ১৩২০ সনে রং পুর সাহিত্য পরিষদ থেকে রজনীকান্ত চক্রবর্তীর সম্পাদনায় ‘অদ্ভুত আচার্যের রামায়ণ’ প্রকাশিত হয়।
এই সময়ের অন্যান্য রামায়ণ অনুবাদক গণঃ
কৈলাস বসু, দ্বিজ লক্ষণ, শঙ্কর চক্রবর্তী , জগদ্রাম ও রামপ্রসাদ রায়
মহিলা রামায়ণ অনুবাদক – চন্দ্রাবতী ।
অনুবাদ সাহিত্যের ধারায় চৈতন্য পূর্ব কালে আমরা রামায়ণের পর পাই ভাগবত অনুবাদ এবং তার কবি মালাধর বসুর নাম। আসুন দেখে নেওয়া যাক।
কবি মালাধর বসু
আবির্ভাব কাল- পঞ্চদশ শতক
জন্মস্থান – বর্ধমানের কুলীন গ্রামে
কবির উপাধি – ‘গুণরাজ খান’
কে দিয়েছিলেন ?
সম্ভবত রুকনুদ্দিন বরবক শাহ। যদিও এ বিষয়ে নানা বিতর্ক আছে। কেননা তাঁর কাব্য রচনাকালে গৌড়েশ্বর ছিলেন দু জন। কাব্য রচনার প্রথম দিকে ছিলেন রুকনুদ্দিন বরবক শাহ। কিন্তু রচনার শেষ দিকে ছিলেন শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহ। তবে মালাধর বসুর কাব্যে প্রথম থেকেই তাঁর প্রাপ্ত উপাধির কথা স্বীকার করার জন্য মনে করা হয় রুকনুদ্দিন বরবক শাহই কবিকে ঐ উপাধি দিয়েছিলেন।
কাব্যের নাম – শ্রী কৃষ্ণবিজয় বা গোবিন্দ মঙ্গল
রচনাকাল – ১৪৭৩ – ১৪৮০ খ্রি। প্রাসঙ্গিক শ্লোকটি হল- ‘তেরশ পচানই শকে গ্রন্থ আরম্ভন / চতুর্দশ দুই শকে হইল সমাপন’
শ্রীকৃষ্ণবিজয় অর্থে শ্রীকৃষ্ণের মহাপ্রয়াণ আবার কারো মতে শ্রীকৃষ্ণের গৌরব গাথা
কাব্যের অবলম্বন – ভাগবতের দশম ও একাদশ স্কন্দ
কাব্যটির বিশেষ পরিচয় – বৈষ্ণব ঐতিহ্যের প্রবেশক গ্রন্থ
ভাগবতের অন্যান্য অনুবাদক
যশোরাজ খান – কাব্যের নাম – কৃষ্ণ মঙ্গল ।
দ্বিজ মাধব – কাব্যের নাম – শ্রীকৃষ্ণ মঙ্গল
কৃষ্ণদাস – মাধব চরিত
কবি শেখর দৈবকী নন্দন – গোপাল বিজয় পাঁচালি
দুঃখী শ্যামাদাস – গোবিন্দ মঙ্গল
কৃষ্ণদাস – শ্রীকৃষ্ণ বিলাস
অভিরাম দাস – শ্রীকৃষ্ণ মঙ্গল
দ্বিজ পরশুরাম – কৃষ্ণ মঙ্গল
রঘুনাথ ভাগবত আচার্য
এরপর আসি মহাভারত অনুবাদ প্রসঙ্গেঃ
মহাভারত অনুবাদক দের মধ্যে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় নাম কাশীরাম দাস। কবির আবির্ভাব ষোড়শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে । জন্ম স্থান বর্ধমানের কাটোয়ার নিকটবর্তী সিঙ্গি গ্রাম।
বংশ পরিচয় – পিতা কমলাকান্ত, তিন ভাই কৃষ্ণ রাম, গদাধর ও কবি কাশীরাম
বংশ গত উপাধি – দেব
কাব্য রচনাকাল – ষোড়শ শতকের শেষ ভাগ।
কাব্যের সংযুক্ত হয়েছে – শ্রীবৎস চিন্তার কাহিনী
কবি কৃত্তিবাস তাঁর কাব্য রচনা সম্পূর্ণ করতে পারেননি । তিনি রচনা করেছেন আদি, সভা, বন ও বিরাট পর্ব। গ্রন্থে আছে
“আদি সভা বন বিরাটের কতদূর / ইহা রচি কাশীরাম গেলা স্বর্গ পুর”। কবির অসম্পূর্ণ অনুবাদ সম্পূর্ণ করার দায়িত্ব নেন তার পুত্র, ভাইপো ও অন্যান্য অনুবাদক কবিগণ।
কবির পুত্রের নাম – সম্ভবত দ্বৈপায়ন দাস। কাব্যে আছে – ‘দ্বৈপায়ন দাসে বলে কাশীর নন্দন’
কবীন্দ্র পরমেশ্বর
প্রকৃত নাম – পরমেশ্বর দাস, কবীন্দ্র হল উপাধি। পরাগল খাঁ এই উপাধি দেন।
কার সভাকবি ছিলেন ?
গৌড়ের সুলতান হোসেন শাহের সেনাপতি লস্কর পরাগল খানের । তাঁর নির্দেশেই কাব্য রচিত হয়।
কাব্যের নাম- পাণ্ডব বিজয় (১৫৩২)। কাব্যটি মহাভারতের ১৮ টি পর্বের অতি সংক্ষিপ্ত অনুবাদ।বাংলায় লেখা এটিই প্রথম মহাভারত অনুবাদ মনে করা হয়।
শ্রীকর নন্দী
কার পৃষ্ঠপোষকতায় কাব্য রচিত হয় ?
পরাগল খানের পুত্র ছুটি খাএর পৃষ্ঠপোষকতায়
কাব্যের উৎস কি ?
জৈমিনি মহাভারতের ‘অশ্বমেধ পর্ব’
কাব্যের রচনাকাল কি ?
মোটামুটি অনুমান ১৫১৮ খ্রি
মহাভারতের অন্যান্য অনুবাদক
রামচন্দ্র খান – রঘুনাথ – অনিরুদ্ধ – বিজয় পণ্ডিত – নিত্যানন্দ দাস – সারলাদাস
তথ্যসূত্র – বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের ইতিকথা, ভূদেব চৌধুরী, এসএসসি টার্গেট এসএলএসটি বাংলা