ধ্বনিতত্ত্ব

ধ্বনি পরিবর্তনের কারণ

বাংলা ব্যাকরণের আলোচনায় ধ্বনি পরিবর্তনের কারণ একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা নানা সময় নানা শব্দ ব্যবহার করি। বিভিন্ন কারণে সেইসব শব্দের উচ্চারণগত নানা রূপ পরিবর্তন ঘটে। কী সেই কারণ ? এই অংশে ধ্বনির পরিবর্তনের নানা কারণগুলি নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।

ধ্বনি পরিবর্তনের কারণ – ধ্বনি পরিবর্তন কী ?

চলমান জীবন প্রবাহে পরিবর্তনশীলতা একটি বাধ্যতামূলক বৈশিষ্ট্য, আর সেই পরিবর্তনশীলতাকে মানুষ প্রকাশ করে তার মৌখিক ভাষার মাধ্যমে, তাই তার পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী l যে কোনো প্রচলিত মৌখিক ভাষাই পরিবর্তনশীল l ছোটবেলায় শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক মহাশয়ের আলোচনায় বার বার এসেছে “কোনো জাতির মৌখিক ভাষা বহমান নদীর মতো” তখন কথাটি একটি প্রবাদ বাক্যের মতো কানে বাজত।

কিন্তু সাহিত্যের ছাত্র হওয়ায় ক্রমশ সেই প্রবাদের গূঢ় রহস্য ভেদ হচ্ছে, – নদী যেমন সময়ের সাথে সাথে এলো মেলো ভাবে তার চলার পথ বদলায়, তেমনি যুগ থেকে যুগান্তরে তার প্রকৃতি বদলায় l নদী বদলায় তার স্রোত, ভাষা বদলায় তার ধ্বনি l নদীর স্রোত ভিন্নমুখী হলে যেমন নদীর গতিপথ বদলায়, তেমনি কালক্রমে মূল ভাষার ধ্বনি পরিবর্তন হতে হতে নতুন ভাষার পরিচিতি পায়, যা মান্য ভাষার অন্তর্গত কিন্তু অন্য নাম নিয়ে বাস্তবে ও ভাষার আলোচনায় আলোচিত হয় l ধ্বনি পরিবর্তনের কারণ সমূহ নীচে আলোচিত হল।

ধ্বনি পরিবর্তনের কারণ

একটি ভাষার ধ্বনি বিভিন্ন কারণে পরিবর্তন হতে পারে, দেখি কীভাবে তা পরিবর্তিত হচ্ছে –

ভৌগোলিক অবস্থান

ভৌগোলিক অবস্থানজনিত কারণে ধ্বনি পরিবর্তন নির্ভর করে -ভৌগোলিক অবস্থানের কারণের ওপর জলবায়ু নির্ভর করে এবং তার ফলে শারীরিক গঠন ও অভিযোজন প্রক্রিয়া নির্ভরশীল l এই জন্য পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের ও সমতলের উচ্চারণের পার্থক্য লক্ষ করা যায় l যে অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি প্রতিকূল ও কঠোর, সেখানকার উচ্চরণ বেশি কঠোর ও কর্কশ এবং যেখানের ভূপ্রকৃতি বৈচিত্রময়, নির্মল, সেখানকার ভাষার উচ্চারণে কোমলতা, সৌন্দর্য্য বেশি – যেমন – ইংরাজি ও জার্মান ভাষা অপেক্ষাকৃত রূঢ় ভাষা আর ফরাসি, স্পেনীয়, ইতালীয় ভাষা অপেক্ষাকৃত মধুর ও কোমল, অনেক ভাষাবিদ এই ধারণা পোষণ করেন l

সামাজিক অবস্থান

শান্তিপূর্ণ অবস্থানে কোনো দেশের ভাষার উচ্চরণগত বিকৃত কম থাকে l কিন্তু যে দেশে যুদ্ধ – বিগ্রহ অথবা বিদেশিদের আগমন ক্রমাগত হতেই থাকে, সেখানকার ভাষার ধ্বনি পরিবর্তনের সম্ভাবনা বেড়েই যায় l আমাদরে ভারতবর্ষের কথাই যদি ধরি – নিয়মিত বিদেশিদের আগমনে ও যোগাযোগের ফলে ভাষার যে ধ্বনিগত পরিবর্তন হয়েছে তা লক্ষণীয় l

যেমন, শ, স, ষ, এই তিন ধরনের শিসধ্বনি পশ্চিমবঙ্গের মান্য চলিত ভাষার মধ্যে থাকলেও মূল ধ্বনি হিসেবে মান্যতা পেয়েছে “তালব্য – শ”ই l কিন্তু এই বাংলা ভাষাভাষীর বাংলদেশে “দন্ত্য -স ” দারুণ ভাবে প্রচলিত l এর কারণ হিসেবে ভাষাবিদদের যুক্তি – মধ্যযুগ থেকেই মুসলমান শাসনের ফলে ফরাসি ভাষার প্রভাবে এই ধ্বনির পরিবর্তন ঘটেছে l

অন্য ভাষার সাহচর্য

বিভিন্ন ভাষার সংস্পর্শে বাংলা ভাষা আসার সূত্রে তার নিজেস্ব ভাষা কিছু কিছু বদলে গেছে l যেমন – বাংলা ‘বন্ধ’ শব্দটি হিন্দি ভাষার প্রভাবে ‘বন্ধ্ ‘ অথবা ‘বন্‌ধ্‌’। সাধরণ বাংলায় বাক্যের ভেতরেই এই রকম অন্য ভাষার প্রভাব থেকে গেছে l যেমন – নেতাজী সুভাষ অমর রহে “

শারীরিক কারণ

মানুষে ভাব বিনিময়ের সবথেকে শক্তিশালী মধ্যম হলো পঞ্চ ইন্দ্রিয় l এই ইন্দ্রিয়গুলির কোনো একটির ত্রুটি থাকলে ধ্বনি পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী l

(ক) বাকযন্ত্রের ত্রুটিজনিত কারণ – বাক্য বিনিময়ের ক্ষত্রে যদি বক্তার জিহ্বার সমস্যা থাকে তাহলে উচ্চারণে মূর্ধণ্যীভবন। যেমন – সেই বক্তা “দিন দুনিয়ার হাল বদলে গেছে, বলতে গিয়ে বলেন – ” ডিন ডুনিয়ার হাল বডলে গেঠে”l

(খ) শ্রোতার শ্রবণ ত্রুটিজনিত কারণ :
শ্রোতার শ্রবণ সমস্যা থাকলে বক্তার বক্তার প্রকৃত উক্তি শ্রোতার কানে প্রকৃত উচ্চরণ বিকৃত ভাবে পৌঁছয় এবং তা উচ্চরণ কালে বিকৃত উচ্চরণই হয়ে যায় l যেমন – ‘zar’ শব্দটির উচ্চরণ ‘তসার ‘ ভালভাবে না শুনতে পেয়ে ‘জার ‘নামক ভুল উচ্চরণ করেন l পরবর্তীকালে সেই ভুলটাই প্রচলিত হয়ে যায় l এ যেন লোকনিরুক্তির আর এক রূপ l

(গ) অশিক্ষা জনিত কারণ –
অশিক্ষিত মানুষরা শব্দের প্রকৃত উচ্চরণ না জানার ফলে অথবা জানা শব্দই চর্চার অভাবে কঠিন শব্দ সহজ করে উচ্চরণ করার প্রবণতা থাকে l ‘নীলদর্পণ ‘ নাটকে আদুরি ‘ ম্যাজিষ্টেট সাহেব ‘ উচ্চরণ করতে না পেরে ‘মাছের টক’ বলে উচ্চরণ করেছে l অনুরূপ ভাবে – ‘গভর্নমেন্ট ‘ কে ”গর্মেন্ট ‘ বলেন l

(জ) সন্নিহিত ধ্বনির প্রভাব :-
সন্নিহিত ধ্বনির প্রভাবে বিজাতীয় ব্যঞ্জন এক ব্যঞ্জনের পরিণত হয় l যেমন – ‘রশ্মি ‘ শব্দ ‘রশ্ শি ‘ তে যখন পরিণত হয়, তখন “ম ” ধ্বনি ‘শ’ ধ্বনিতে পরিণত হয় l

শেষকথা

পরিশেষে বলা যায়, ধ্বনির এই বিচিত্র পরিবর্তন আশ্চর্য্যের নয়, অতি পরিচিত শব্দের এই ক্রমপরিবর্তন দেখে নাক -মূখ কুঁচকে নিজের অসন্তোষকে চেপে না রেখে মেনে নিতে শিখতে হবেl মনে রাখতে হবে, একটি ভাষা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে মানুষের মুখে যুগ যুগ ধরেবেঁচে থাকার একটি শক্তিশালী মাধ্যম হলো এই ধ্বনি পরিবর্তন l যেকোনো ভাষার শব্দকে চিরশুদ্ধ করে ভাষায় ব্যবহার করার প্রয়াস করা বোকামি ছাড়া কিছু না l যদি তাই হয় তাহলে সেই ভাষার স্থান হবে (সংস্কৃত ভাষার মতো) মানুষের মুখে নয়, ইতিহাসে l

ধ্বনি পরিবর্তন কীভাবে হয় ? কী কী তার রীতি ? এই সমস্ত আলোচনা পেতে ক্লিক করুন।

আলোচক – নীলরতন চট্টোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *