
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত – বাংলা সাহিত্যের গুপ্ত কবি
ইংরেজি ভাষা তাঁর আয়ত্তের মধ্যে ছিল না, এমন কি সেই সময়কার অর্থকরী ভাষা ফারসীও ”কাজ চলা গোছের জানা”ছিল, কবিতা রচনাই যাঁর ধ্যান জ্ঞান, তিনি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। কবিতা তাঁর ”সখের ব্যাপার ছিল না”, তিনি কবিতা লিখতেন ”অন্তরের টানে”। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বাংলা সাহিত্যের প্রভাকর। এই পোস্টে উক্ত কবির জীবন ও সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের রসিক পাঠকের আশা করি ভালো লাগবে।
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত
বাংলা ভাষায় তিনিই প্রথম দৈনিক পত্রিকা (‘সংবাদ প্রভাকর’) ১৮৩১ প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর ‘বোধেন্দুবিকাশ’ নাটকের গান স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ”জীবনস্মৃতি”তে ব্যবহার করেন। ভারতচন্দ্র থেকে রামপ্রসাদ প্রমুখ প্রাচীন কবিদের জীবনী গুপ্ত কবিই প্রথম সংগ্রহ করেন।
“কে বলে ঈশ্বর গুপ্ত ব্যাপ্ত চরাচর, যাঁহার প্রভায় প্রভা পায় প্রভাকর”
ঈশ্বর গুপ্ত ১৮১২ খ্রিষ্টাব্দে কাঁচড়াপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ছিলেন হরিনারায়ণ গুপ্ত, মাতা শ্রীমতী দেবী। ঈশ্বর গুপ্ত ছোটো থেকেই মায়ের সঙ্গে মামা বাড়িতে থাকতেন। কবির দশ বছর বয়সে মাতৃবিয়োগ হলে পিতা দ্বিতীয় বার বিয়ে করলে বিমাতাকে কবি মেনে নিতে পারেন নি। বঙ্কিমচন্দ্র এ বিষয়ে বলেছেন –
”ঈশ্বরচন্দ্রের এই মহৎ গুণ ছিল যে তিনি খাঁটি জিনিস বড় ভালোবাসিতেন, মেকির বড় শত্রু । …….খাঁটি মা কোথায় চলিয়া গেছে, তাহার স্থানে মেকি মা আসিয়া দাঁড়াইল” (দ্রঃ ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতা সংগ্রহ, ভূমিকা অংশ)
উল্লেখযোগ্য রচনা
‘কবিবর ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের জীবনবৃত্তান্ত’ (১৮৫৫) ‘প্রবোধ প্রভাকর’ (১৮৫৮) ‘বোধেন্দুবিকাশ’ নাটক (১৮৬৩) ‘সত্যনারায়ণ পাঁচালী’ ‘হিতপ্রভাকর'(১৮৬১) প্রভৃতি
সকুমার সেন গুপ্ত কবির কবিতা গুলিকে বিষয়বস্তু অনুসারে তিন ভাগে ভাগ করেন –
১। পারমার্থিক নৈতিক
২। সামাজিক
৩। প্রেমরসাত্মক
ঈশ্বর গুপ্তের অধিকাংশ রচনা ”সংবাদ প্রভাকর ”পত্রিকাতেই প্রকাশিত হত। তাঁর ‘প্রবোধ প্রভাকর’ ”নীতি ও ধর্ম শিক্ষা” (সুকুমার সেনের মতে) বিষয়ক গদ্যে ও পদ্যে লেখা গ্রন্থ।
”বোধেন্দু বিকাশ” নাটকটি ”প্রবোধচন্দ্রোদয়” নাটকের অনুবাদ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ‘বোধেন্দু বিকাশ’ নাটকের প্রস্তাবনায় নটীর গানের প্রথম দুটি কলি রবীন্দ্রনাথ ‘জীবনস্মৃতি’তে ব্যবহার করেন। শুধু তাই নয় ‘বোধেন্দু বিকাশ’ নাটকটিকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর মঞ্চস্থ করারও উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
গুপ্ত কবি অতি তু্চ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়কে নিয়ে কবিতা লিখতেন। যেমন:- পাঁঠা, তপসে মাছ, পিঠাপুলি, আনারস, প্রভৃতি
‘তপসে মাছ’ কে নিয়ে কবিতা –
”কর্ষিত কনককান্তি কমনীয় কায়।
গাল ভরা গোঁফ দাড়ি তপস্বীর প্রায়।।
কবি ছিলেন খাঁটি দেশপ্রেমী। তাঁর দেশপ্রেমূলক কবিতাগুলি তার প্রমানঃ
”মিছা মণিমুক্তা হেম স্বদেশের প্রিয় প্রেম
তার চেয়ে রত্ন নাহি আর।।
তিনি মনে প্রাণে স্ত্রী শিক্ষার বিরোধী ছিলেন, তার পরিচয় কবিতার মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে:-
”আগে মেয়ে গুলো ছিল ভালো ব্রতধর্ম কর্তো সবে।
একা বেথুন এসে শেষ করেছ অার কি তাদের তেমন পাবে”।
গুপ্ত কবি বিধবাবিবাহেরও কট্টর বিরোধী ছিলেনঃ-
”সকলেই এইরূপ বলাবলি করে
ছুঁড়ির কল্যাণে যেন বুড়ি নাহি তারে”।।
গুপ্ত কবি ”সংবাদ প্রভাকর” ছাড়াও আরো কতকগুলি পত্রিকা প্রকাশ করেন – ‘সংবাদ রত্নাবলী'(১৮৩১), ‘পাষণ্ডপীড়ন’ (১৮৪৬), ‘সংবাদ সাধুরঞ্জন'(১৮৪৭)
সবশেষে বিষ্ণু দে উক্তি স্মরণ করা যেতে পারেঃ-
”গত শতাব্দীতে মধ্যবিত্ত বাঙালী আমরা পরম উৎসাহে নতুন শিক্ষায় মেতেছিলুম, তখন সে উৎসাহ ছিল স্বাভাবিক, একমাত্র সোজা পথ। সমাজ ব্যবস্থায় মোড় ফেরার সময় তখন নতুন শিক্ষায় ছিল জীবিকার ভরসা এবং নতুন জীবনযাত্রার আশা। সে আশা ভরসার চেহারা আজকে স্পষ্ট হয়েছে অনেক নৈরাশ্যের সংঘর্ষে। তাই আজকে আমাদের উত্তারাধিকার আবিষ্কার করতে হলে যাঁদর রচনাবলী বিচার করতে হবে, তাঁদের মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের বিশেষ মর্যাদা”।
”ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত” (বিষ্ণু দে)