ধ্বনিতত্ত্ব

ভারতীয় লিপি প্রসঙ্গকথা

যেকোন ভাষার অন্যতম উপাদান তার লিপি। আদিমকাল থেকেই মানুষ তার কোনো অনুভূতি প্রকাশ বা কোনো বিষয়কে ব্যক্ত করার মাধ্যমের সন্ধান করেছে। আর সেই প্রবণতাতেই জন্ম হয়েছে বিভিন্ন লিপির। আমাদের এই আলোচনায় বিভিন্ন ভারতীয় লিপি যেমন ব্রাহ্মী লিপি খরোষ্ঠী লিপি সিন্ধুলিপি সম্পর্কে সুসংবদ্ধ আলোচনা করা হয়েছে।

১] ভারতীয় লিপি – সিন্ধুলিপি

সিন্ধু উপত্যকায় প্রাপ্ত সিন্ধুলিপিই ভারতের প্রাচীনতম লিপি। কিন্তু এখনও পর্যন্ত এই লিপির যথার্থ পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়নি। সিন্ধু সভ্যতা মিশর ও সুমের সভ্যতা সমসাময়িক। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়ো থেকে পাওয়া শীলমোহর ও শিলালিপিতে খোদিত রয়েছে এই লিপির অজস্র নিদর্শন। প্রাপ্ত নিদর্শনগুলি থেকে সিন্ধুলিপি পরীক্ষা করে দেখা গেছে সুমেরীয়, প্রোটোইলামাইট, হিট্টাইট, মিশরিয়, ক্রিটিয় এবং চীনালিপির প্রাথমিক রূপের সঙ্গে এর সাদৃশ্য চোখে পড়ে। সিন্ধুলিপিতে একাধিক লিখনরীতি প্রচলিত ছিল। অধিকাংশই ব্রাহ্মী লিপির মত বাম থেকে ডান দিকে। খরোষ্ঠী লিপির মত ডান থেকে বামে লেখাও পাওয়া যায়। এছাড়া উপর থেকে নীচে, নীচ থেকে উপরে লিখিত নিদর্শনও আছে।

আধুনিককালে নির্মলকুমার বর্মা সিন্ধুলিপি নিয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন। তিনি সিন্ধুলিপিকে যেভাবে বিন্যস্ত করেছেন তার চিত্র দেওয়া হল –

 

২] ভারতীয় লিপি – ব্রাহ্মী ও খরোষ্ঠী লিপি

সিন্ধুলিপিকে বাদ দিলে ভারতের আদি লিপি ব্রাহ্মী ও খরোষ্ঠী। বহু বছর আগে থেকেই এই দুই লিপিতে লেখা অজস্র নিদর্শনের সন্ধান পাওয়া গেছে – এদেশের প্রাচীন মুদ্রায়, ধাতু নির্মিত পাত্রে, পাহাড়ে, পাথরের ফলকে এবং স্তম্ভের গায়ে। আমাদের প্রথম আলোচ্য খরোষ্ঠী লিপি।

পৃথিবীর অন্যান্য প্রাচীন লিপির মতই অনেককাল অবধি এদের পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়নি। এই কাজটি প্রথম সার্থকভাবে সম্পাদন করেন জেমস্‌ প্রিন্সেফ। মাত্র ২০ বছর বয়সে টাঁকশালে চাকরি নিয়ে তিনি কলকাতায় আসেন। এরপর, প্রথমে এশিয়াটিক সোস্যাইটির সদস্য ও পরে তার সচিব নির্বাচিত হন। পুরাতত্ত্বে তাঁর অসীম আগ্রহ, এদেশীয় প্রাচীন মুদ্রা, শিলমোহর এবং লিপির প্রতি তাঁকে উৎসাহী করে তোলে। এইভাবে তিনি ১৮৩৭ – ৩৮ সাল নাগাদ সাঁচি স্তুপে প্রাপ্ত অশোকের শিলালিপি থেকে ব্রাহ্মী ও পেশোয়ারের কাছে পাওয়া অশোকেরই অনুশাসন থেকে খরোষ্ঠী লিপির সম্পূর্ণ পাঠোদ্ধার করেন।

খরোষ্ঠী লিপি মূলত ডান দিক থেকে বাম দিকে লেখা হত। এই লিপি ভারত ছাড়াও পূর্ব তুর্কিস্তান, নিয়া, লৌ – লান প্রভৃতি স্থানে প্রচলিত ছিল।

‘খরোষ্ঠী’ শব্দটি ইরানি ‘খরপোস্ত’ শব্দ থেকে এসেছে। ‘খর’ অর্থে ‘গাধা’ এবং ‘পোস্ত’ অর্থে ‘চামড়া’। অর্থাৎ ব্যুৎপত্তিগতভাবে ‘খরোষ্ঠী’ শব্দের অর্থ ‘গাধার চামড়া’। মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে খরোষ্ঠী লিপির যে প্রাচীন নিদর্শনগুলি পাওয়া গেছে তার অধিকাংশই উট, ঘোড়া বা গাধার চামড়ায় উৎকীর্ণ। আর সেকারণে ‘খরোষ্ঠী’ নামকরণ সঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে হয়।

 

৩] ভারতীয় লিপি – ব্রাহ্মী লিপি

প্রাচীন তত্ত্বের নিরিখে ব্রাহ্মী লিপি , খরোষ্ঠী লিপির থেকে কিছুটা অর্বাচীন হলেও খ্রিষ্টের জন্মের অন্তত ন’শো বছর আগে এ লিপির জন্ম। এই লিপির লিখনরীতি বাম দিক থেকে ডান দিকে। এখনও পর্যন্ত অশোকের যে অনুশাসন ও শিলালিপিগুলি পাওয়া গেছে তার অধিকাংশই এই লিপিতে লেখা।

বৌদ্ধদের ললিতবিস্তরে যে চৌষট্টি টি লিপির কথা বলা হয়েছে তার প্রথমটি ব্রাহ্মী। প্রাক অশোক যুগের বড়লী-র একটি স্তম্ভের গায়ে এবং নেপালের পিপ্‌রাওয়া স্তুপে প্রাপ্ত পাত্রলিপিতে ব্রাহ্মী লিপির যে যৎসামান্য নমুনা পাওয়া গেছে তা খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকের। অবশ্য এই লিপির সঙ্গে অশোকের সময়ের ব্রাহ্মীলিপির তেমন কোন বৈসাদৃশ্য নেই।

যারা মনে করেন বিদেশি উৎস থেকে ব্রাহ্মী লিপির জন্ম হয়েছে তাদের মতে সেমিয় ও হামিয় ভাষা বংশের সেমিয় লিপি থেকে এর জন্ম। সেমিয় শাখার দুটি উপশাখা। একটি পূর্বী, অপরটি পশ্চিমা। পূর্বী উপশাখা থেকে এসেছে অসিরিয়, অক্কাদিয় এবং ব্যাবিলনিয় ভাষা। পশ্চিমা শাখার দুটি ভাগ – দক্ষিণা ও উত্তরা। উত্তরাভাগ থেকে কানানিয়, ফিনিসিয় এবং আরামিয় ভাষার উদ্ভব। এর মধ্যে ফিনিসিয় ও আরামিয় ভাষাভাষীরা মিশরিয়দের কাছ থেকে লিপিবিদ্যা গ্রহণ করেন এবং ফিনিসিয় ও আরামিয় বর্ণমালা গড়ে তোলেন। সেমিয় লিপির ঠিক কোন ধারা বা উপধারা থেকে ব্রাহ্মী লিপির জন্ম তা নিয়ে যথেষ্ট মতানৈক্য আছে।

আরো পড়ুন

ব্রাহ্মী লিপির প্রসারের ফলে খ্রিষ্টিয় প্রথম – দ্বিতীয় শতাব্দীতে এর তিনটি আঞ্চলিক রূপ গড়ে ওঠে। এগুলি হল – উত্তর ভারতীয়, দক্ষিণ ভারতীয় এবং বহির্ভারতীয়। বহির্ভারতীয় লিপি থেকে তিব্বতি, বর্মী, যবদ্বীপী প্রভৃতি লিপির জন্ম। দক্ষিণ ভারতীয় লিপি থেকে তেলেগু, তামিল প্রভৃতি লিপি এবং উত্তর ভারতীয় লিপি থেকে যে দুই বিশিষ্ট লিপির জন্ম হয় তার একটি নাগরী এবং অন্যটি বাংলা লিপি।

অনেককাল অপরিবর্তিত থাকার পর উত্তর ভারতীয় ব্রাহ্মী লিপি কুষাণ ও গুপ্ত যুগে এসে আকারগতভাবে বিবর্তিত হতে শুরু করে। খ্রিষ্টিয় সপ্তম শতাব্দী নাগাদ অঞ্চলভেদে তিনটি ভিন্নধারায় বিকশিত হয়। উত্তর – পশ্চিম ভারতে এর নাম সারদালিপি, উত্তর ভারতে নাগরলিপি এবং উত্তর ভারতেই পূর্ব সীমান্তে এ লিপির যে পরিবর্তিত রূপটি গড়ে ওঠে তার নাম কুটিল লিপি।কুষাণ আমলে অর্থাৎ খ্রিষ্টিয় প্রথম থেকে তৃতীয় শতকে ব্রাহ্মী লিপির যে রূপটি প্রচলিত ছিল তা কুষাণলিপি।

উত্তর ভারতীয় ব্রাহ্মী লিপির পূর্ণ বিকশিত রূপটি গড়ে ওঠে খ্রিষ্টিয় চতুর্থ – পঞ্চম শতকে গুপ্ত আমলে। এ লিপির নাম ‘গুপ্তলিপি’। গুপ্তলিপিতে কুষাণ লিপির কিছু বৈশিষ্ট্য থাকলেও এই লিপিতে প্রায় সমস্ত বর্ণের মাথাতেই সংক্ষিপ্ত মাত্রার প্রয়োগ প্রচলিত ছিল। অঞ্চলভিত্তিতে এই লিপিরও দুটি ভাগ – পূর্বী ও পশ্চিমা। গুপ্ত লিপির পূর্বভাগ থেকে খ্রিষ্টিয় ষষ্ঠ শতকে সিদ্ধমাত্রিকা লিপির জন্ম হয়। এই সিদ্ধমাত্রিকা লিপির একটি জটিল রূপ – কুটিল লিপি।

কুটিল লিপি সেই অর্থে কোনো রাজার শাসনকালের সঙ্গে জড়িত নয়। এটি গুপ্ত পরবর্তী লিপি। এই লিপির আকার যেহেতু অত্যন্ত জটিল ও কুটিল তাই এরকম নাম। নাগরী বা দেবনাগরী লিপির মত ভারতে বহুল প্রচলিত লিপিও এই কুটিল লিপি থেকে উদ্ভূত। খ্রিস্টিয় সপ্তম – অষ্টম থেকে একাদশ – দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে এই লিপি পূর্ণ বিকশিত আধুনিক রূপ লাভ করে। এখনকার সংস্কৃত, হিন্দি, নেপালী, মারাঠি প্রভৃতি ভাষায় এই লিপির ব্যাপক প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়।

আলোচক – ডঃ সৌগত মুখোপাধ্যায়, সহকারী অধ্যাপক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *