মতি নন্দী – জীবনী ও রচনাবলী
মতি নন্দী বাংলা কথাসাহিত্যের অপ্রতিদ্বন্দ্বী স্রষ্টা। তাঁর আসল নাম মতিলাল নন্দী। বাংলা ‘ক্রীড়াসাহিত্য’ তাঁর হাতেই প্রাণ পেয়েছে।
মতি নন্দী বাংলা কথাসাহিত্যের খ্যাতনামা লেখক। তাঁর খেলাধুলার সঙ্গে আশৈশব ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। পেশাগত পরিচয় মূলত ক্রীড়া সাংবাদিক হলেও মতি নন্দী তাঁর লেখনীর অসামান্য শিল্পনৈপূণ্যে সাংবাদিকতার পরিধিকে অতিক্রম করে সাহিত্যের আঙিনায় নিজের সৃষ্টিকে পৌঁছে দিয়েছেন। খেলাধুলার বিষয়বস্তু, নিজেস্ব ভাষাভঙ্গী, তীব্র বিদ্রুপ আর অবিস্মরণীয় শিল্পদৃষ্টি তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। মতি নন্দী দীর্ঘদিন উত্তর কলকাতায় গোষ্ঠ পালের প্রতিবেশী ছিলেন। তাঁর প্রিয় লেখক ছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।
পরিচিতি
১৯৩১ সালে ১০ জুলাই উত্তর কলকাতার তারক চ্যাটার্জি লেনে তাঁর জন্ম। পিতার নাম চুনীলাল নন্দী এবং মাতার নাম মলিনাবালা নন্দী। মতি নন্দী র মা ছিলেন তাঁর পিতার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী। চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনিই ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। তাঁর পূর্বপুরুষদের পদবি ছিল দে সরকার। পিতামহ তাঁর চাকরিস্থলে পদবি বদল করে ‘নন্দী’ গ্রহণ করেন। মতি নন্দীর পিতা সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন।
শিক্ষা ও কর্মজীবন
মতি নন্দী পিতা শৈশবেই প্রয়াত হন। ১০ বছর বয়সে স্কটিশচার্চ স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৪৮ সালে এখান থেকেই ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৫০ সালে আই এস সি পাস করেন। ১৯৫১ সালে অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ডিপ্লোমা অর্জন করেন। এবং পরে ১৯৫৭ সালে মণীন্দ্রচন্দ্র কলেজ থেকে বাংলা অনার্সসহ বিএ পাস করেন।
১৯৫২ সালে স্টেট ট্রান্সপোর্ট কোম্পানিতে বিনা বেতনে অ্যাপ্রেন্টিস হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। তার পরে কিছুদিন স্কুলে শিক্ষকতা করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি নীতি নন্দীকে বিবাহ করেন। বিবাহের পর সংসারের তাগিদে স্থায়ী চাকরি যে কতটা আবশ্যক তা তিনি অনুভব করেন এবং ১৯৬৯ সালে আনান্দবাজার পত্রিকায় চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৯৪ সালে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
সাহিত্যে মতি নন্দির অবদান
১৯৫৩ সালে গল্প লেখার মধ্য দিয়ে সাহিত্য সৃষ্টির সূচনা হয়। ১৯৫৬ তে ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘ছাদ’ গল্প এবং ‘পরিচয়’ পত্রিকায় ‘চোরা ঢেউ’ প্রকাশিত হয়। এর পর থেকে শুরু হয় তাঁর একের-পর-এক নতুন সাহিত্যসম্ভার। ১৯৫৮ সালে ‘শারদীয়া পরিচয়’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর গল্প ‘বেহুলার ভেলা’ পাঠক মহলে সাড়া ফেলেছিল। তিনি যেমন বড়োদের জন্য অনেক রচনা রচিত করেছেন, তেমনি শিশু-কিশোরদের জন্যও সমান দক্ষতায় অনেক গল্প-উপন্যাস লিখেছেন।
উপন্যাস – ‘কোনি’, ‘নায়কের প্রবেশ ও প্রস্থান’, ‘নক্ষত্রের রাত’, ‘দ্বাদশ ব্যক্তি’, ‘করুণাবসত’, ‘দূরদৃষ্টি’, ‘জীবন্ত’, ‘ছায়া’, ‘সাদা খাম’, ‘দ্বিতীয় ইনিংসের পর উভয়ত সম্পূর্ণ’, ইত্যাদি।
কিশোর উপন্যাস – ‘স্ট্রইকার’, ‘স্টপার’, ‘নদীটা নট আউট’, ‘অপরাজিত আনন্দ’, ‘কলাবতী’, ‘শিবা’, ‘মিনু চিকুর ট্রফি’, ‘বুড়ো ঘোড়া’, ‘জীবন অনন্ত’, ‘তুলসী’ ইত্যাদি।
গল্প সংকলন – ‘বেহুলার ভেলা’, ‘নির্বাচিত গল্প’, ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’, ‘কপিল নাচছে’, ‘ষোলকে পনেরো করা’, ‘গল্পসংগ্রহ’, ‘এম্পিয়ারিং’ ইত্যাদি। প্রবন্ধ গ্রন্থ- ‘খেলার যুদ্ধ’, ‘ক্রিকেটের আইন কানুন’, ‘ক্রিকেটের রাজাধিরাজ’, ‘ক্রিকেটের ডন’, ‘বিশ্বজোড়া বিশ্বকাপ’, ‘একদা ক্রিকেট’ ইত্যাদি। এ সমস্ত রচনার জন্য মতি নন্দী বাংলা সাহিত্যে চিরস্থায়ী আসন লাভ করেন এবং চিরস্মণীয় হয়ে আছেন প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে।
মতি নন্দী ১৯৭৪ সালে ‘আনন্দ’ পুরস্কারে সম্মানিত হন। ১৯৯১ সালে ‘সাদা খাম’ উপন্যাসের জন্য ‘সাহিত্য আকাদেমি’ পুরস্কার পেয়েছেন। ২০০০ সালে শিশু-কিশোর সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য ‘বাংলা অ্যাকাডেমি’ পুরস্কার পান। এছাড়াও ২০০২ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘শরৎস্মৃতি’ পুরস্কারে ভূষিত হন। মতি নন্দী দীর্ঘদিন ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র ক্রীড়া সম্পাদক ছিলেন। বাংলা সাহিত্যজগতের জনপ্রিয় সাহিত্যিক ২০১০ সালে ৩ জানুয়ারি দেহত্যাগ করেন।
আলোচকঃ আজিজুল হক, মালদা, পশ্চিমবঙ্গ।
আনন্দ পেলাম মতি নন্দীর জীবনী পড়ে
সংগ্রামী পরিচয়ে জীবন উঠেছিল গড়ে।