ধর্মমঙ্গল

ধর্মমঙ্গল কাব্যকাহিনী

বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে যে মঙ্গলকাব্য ধারা সাহিত্য সম্ভার কে সমৃদ্ধ করেছে সেগুলির মধ্যে ধর্মমঙ্গল কাব্যের ধারা অন্যতম। আমাদের এই আলোচনায় মঙ্গলকাব্যের বিশেষ ধারা ধর্মমঙ্গল কাব্যের নানা দিক ও কাহিনী র উপর আলোকপাত করা হয়েছে।

সাধারণ পরিচয়

ধর্মঠাকুর পুরুষ দেবতা। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় উনিশ শতকের শেষের দিকে বাংলাদেশের গ্রামান্তর থেকে ধর্মমঙ্গল, ধর্মঠাকুরের ছড়া, শূন্যপূরাণ প্রভৃতি পুঁথি আবিষ্কার করেন।এবং ধর্মঠাকুরের পরিচয় ব্যাখ্যা করেন।ধর্মঠাকুরের পুজা এখনো পশ্চিম ও দক্ষিণবংগে প্রচলিত আছে বলে জানা যায়।বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধর্মঠাকুরের মন্দির গুলিতে নির্দিষ্ট আকারের কোনো মূর্তি পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন আকারের শিলামূর্তি পাওয়া যায়। বিভিন্ন গবেষক ধর্মঠাকুরকে প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ দেবতা বলে মনে করেন।

পূজাপদ্ধতি

রাঢ দেশে ধর্মঠাকুর এখনো জাগ্রত দেবতা তার পুজা বেশ সমারোহ করেই পালিত হয়।ধর্মমঙ্গল কাব্যকে রাঢের জাতীয় মহাকাব্য বলা হয়।ডোম সমাজের পুরোহিত এখনো পুরুষানুক্রমে এই পূজা করে আসছেন বলে জানা যায়। এছাড়া ও জেলে,নাপিত,বাগদী, যুগি, সদগোপ, ময়রা,ধোপা,আগুরি এরা ও এই দেবতার পূজা করেন।

ধর্মঠাকুরের মন্দির বা পীঠস্থান এ চৈত্র সংক্রান্তি থেকে শ্রাবণী পূর্ণিমার মধ্যে বারোদিন খুব ঘটা করে পুজা হয়। এই উপলক্ষে ধর্মের কাহিনী বারো রাত্রি ধরে পঠিত হয় এর নাম বারোমতি বা কর্মাতি।
১ম মতি-রঞ্জার জম্ন
২য় মতি-হরিশ্চন্দ্রের উপাখ্যান
৩য় মতি-শিশু লাউসেনের অপহরন চেষ্টা, লাউসেনের আখড়ায় দূর্গার আবির্ভাব এবং লাউসেনের চরিত্রবল পরীক্ষা।
৪য় মতি-মল্লবধ, ফলক নির্মান,কুম্ভরী ব্যঘ্রাদি বধ।
৫ম মতি-বারুইপাড়ার বর্ননা,সুরিক্ষার দম্ভনাশ
6ষ্ঠ মতি-হস্তিবধ ও লাউসেনের দেশে প্রত্যাবর্তন
৭ম মতি-কামরুপে কলিংগার সংগে লাউসেনের বিবাহ।
৮ম মতি-লৌহ গন্ডার ক্ষয়।
৯ম মতি-ইছাই ঘোষ বধ।
১০ম মতি-গৌড়ে অতিবৃষ্টি নিবারন।
১১দশ মতি-লাউসেন কতৃক ধর্মের সেবা ও ময়না নিধন।
১২দশ মতি-পশ্চিমে সূর্য্যোদয়

বিভিন্ন কবি

ধর্মপুজার প্রথম প্রবর্তক রামাই পণ্ডিত। তারগ্রন্থের আসল নাম আগম পুরান বা রামাই পন্ডিতের পদ্ধতি। তবে এতে নানা স্থানে শুন্যের উল্লেখ আছে বলে এর সম্পাদক নগেন্দ্রনাথ বসু একে শুন্যপুরান বলে অভিহিত করেছেন।
বংগীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে অধ্যাপক বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় শ্রীধর্মপুরান নামে একটি কাব্য প্রকাশিত হয়েছিল।এর রচয়িতা ময়ুর ভট্ট ছিলেন সমস্ত ধর্ম মঙ্গলকাব্যের আদি কবি।
এছাড়া ও খেলারাম চক্রবর্তী, রামদাস আদক,সীতারাম দাস,যাদবনাথ,মানিকরাম গাংুলী, শ্যাম পন্ডিত প্রভৃতি ধর্ম মঙ্গল রচয়িতার নাম পাওয়া যায়। ধর্মমঙ্গল কাব্যের দুজন প্রধান রচয়িতা হলেন সপ্তদশ শতাব্দীর রুপরাম চক্রবর্তী আর অষ্টাদশ শতাব্দীর ঘনরাম চক্রবর্তী। ধর্ম মঙ্গল কাব্যের শ্রেষ্ঠ কবি রুপরাম চক্রবর্তী।

কাহিনি পরিচয়

ধর্মমঙ্গল কাব্যের দুটি কাহিনী। রাজা হরিশ চন্দ্রের কাহিনী ও লাউসেনের কাহিনী।
রাজা হরিশচন্দ্রের কাহিনী 

রাজা হরিশ চন্দ্র ও তার স্ত্রী রানী মদনা ছিলেন নিঃসন্তান। মনের দুঃখে স্বামী ও স্ত্রী ঘুরতে ঘুরতে বল্লুকা নদীর তীরে উপস্থিত হয়ে দেখতে পান ভক্তেরা ধর্মের পূজা করছে।তারাও সন্তান লাভের আশায় ধর্মের পূজা শুরু করলেন এবং পুত্র সন্তান লাভের বর লাভ করলেন।কিন্তু এই শর্তে যে ওই পুত্রকে যথাকালে ধর্মের কাছে বলী দিতে হবে।সন্তানের মুখ দর্শনের আশায় রাজা ও রানী রাজী হয়ে যান। যথাসময়ে পুত্র জন্মায় বড় হয়।তার নাম রাখা হয় লুইচন্দ্র বা লুইধর।কিন্তু রাজা ও রানী প্রতিজ্ঞা ভুলে যান। একদিন ধর্মঠাকুর ব্রাহ্মনের বেশে তাদের গৃহে উপস্থিত হন।
একাদশীর ব্রত পার করার জন্য লুইধরের মাংস আহারের ইচ্ছা প্রকাশ করেন।ব্রাহ্মনের সেবায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ রাজা রানী লুইধর কে হত্যা করে তার মাংস ব্রাহ্মন কে আহার করতে দেন।তখন ধর্ম তাদের নিষ্ঠা দেখে সন্তুষ্ট হয়ে নিজ মুর্তি ধারন করে লুইচন্দ্রকে জিবন্ত ফিরিয়ে দেন।তারপর রাজা মহাসমারোহে ধর্মের পূজা শুরু করেন।এই কাহিনীটিকে ধর্মের সবচেয়ে আদিম কাহিনী বলে মনে করা হয়।

লাউসেনের কাহিনী

এই কাহিনী সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও জনপ্রিয় কাহিনীর মর্যাদা লাভ করেছে।গৌড়েশ্বরের সামন্ত্ব রাজা কর্নসেনের ছয় ছেলে অপর এক পরাক্রমশালী সামন্ত্বের আক্রমনে নিহত হন।এমতাবস্থায় কর্নসেন পুত্রশোকে কাতর হয়ে পড়েন।তখন গৌড়েশ্বর তার প্রিয় সামন্ত্ব কে পুনরায় গৃহবাসী করার জন্য নিজ শ্যালিকা রঞ্জাবতীর সংগে বৃদ্ধ কর্নসেনের বিবাহ দেন।এদিকে এই বিবাহের সংবাদে রঞ্জাবতীর ভাই মহামদ খুব চটে গিয়ে কর্নসেন কে আঁটকুড়ো বলে উপহাস করেন।স্বামীর অপমানে অভিমানী হয়ে রঞ্জা ধর্মঠাকুর এর কাছে শূলে ভর দিয়ে প্রানত্যাগ এর মত কঠিন কৃচ্ছ্রসাধন করতে গেল।অবশেষে ধর্ম আবির্ভূত হয়ে তাকে পুত্রলাভের বর দান করেন।সেই পুত্র হলে তার নাম হয় লাউসেন।মাতুল মহামদ তাকে শিশুকালেই বিনাশ এর নানা চেষ্টা করতে লাগলো।

কিন্তু ধর্মের কৃপায় লাউসেন প্রতিবার রক্ষা পায়।ক্রমে লাউসেন হয়ে উঠে অসাধারন বীর। তার খ্যাতি অর্জন করে সে। জন্তু জানোয়ার মেরে এবং ব্যাপিকা রমণী দের কবল থেকে নিজেকে রক্ষা করে সে সাহস ওচারিত্রিক দৃঢ়তার পরিচয় দেয়।মহামদের কুপরামর্শে গৌড়েশ্বর তাকে বিভিন্ন কঠিন কাজের নির্দেশ দিতে থাকেন।এবং প্রতিবার লাউসেন সেই নির্দেশ বিরত্বের সংগে পালন করে।কালক্রমে লাউসেন প্রতিবেশি রাজাদের হারিয়ে তাদের কন্যাকে বিবাহ করে।লাউসেনের কোনো রকম ক্ষতি করতে না পেরে মহামদ বৃদ্ধ গৌড়েশ্বর কে বলেন লাউসেন কে পশ্চিমে সূর্যোদয় দেখাতে।ধর্মের কৃপায় সেই অসম্ভব কে ও লাউসেন সম্ভব করে দেখান ফলে চারিদিকে লাউসেন এর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।

দুষ্কর্মের ফল স্বরুপ মহামদের কুষ্ঠরোগ হয় ও ধর্মের নিকট লাউসেনের অনুরোধ এ সুস্থ হন।।এই ভাবে ধর্মের মহিমা ছড়িয়ে পড়ে। লাউসেন পরম গৌরবে রাজত্ব করতে থাকেন। তার পরে পুত্র চিত্রসেন এর হাতে রাজ্যভার তুলে দিয়ে স্বর্গ যাত্রা করেন।
এই কাহিনীতে কিছু ইতিহাসের ছোঁয়া আছে।কিন্তু ঐতিহাসিক দাবী না মানলেও কাব্যটিতে বাস্তব জীবনচিত্র,যুদ্ধবিগ্রহের জীবন্ত বর্ননা এবং রাঢ়দেশ এর পুরাতন যুগের জীবন আলেখ্য অনস্বীকার্য।

আলোচক – সুমনা সাহু, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়

3 thoughts on “ধর্মমঙ্গল কাব্যকাহিনী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *