অন্যান্য সাহিত্যিক

আশুতোষ মুখোপাধ্যায় – জীবন ও সাহিত্য

শুধু রবীন্দ্রযুগ নয়, তারপরেও তারাশংকর, বনফুল, মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর সমকালের যে সমস্ত তরুণ লেখক লেখিকা বাংলা কথাসাহিত্যের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম সাহিত্যিক আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। আমাদের এই আলোচনায় সাহিত্যিক আশুতোষ মুখোপাধ্যায় -এর জীবন ও সাহিত্য সম্পর্কে নানা তথ্য উপস্থাপনের প্রয়াস করা হয়েছে।

জন্ম ও শিক্ষা

সাহিত্যিক আশুতোষ মুখোপাধ্যায় -এর জন্ম বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকার অন্তর্গত বজ্রযোগিনী গ্রামে। সময়কাল ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ৭ সেপ্টেম্বর। পিতার নাম পরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং মাতা তরুবালা দেবী। পিতা পেশায় ছিলেন স্কুল ইনস্পেক্টর। আর এই সুবাদে তাঁকে নানা সময় নানা জায়গায় দিন অতিবাহিত করতে হয়েছে। তাঁর প্রথম জীবনের অনেকটা সময় কেটেছে উত্তরবঙ্গে। পরবর্তীকালে চুঁচুড়া থেকে বিদ্যালয় জীবনের পাঠ সমাপ্ত করেন। এরপর হুগলী মহসিন কলেজ থেকে আই. এস. সি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। বি. এমে ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু এসময়ে তাঁর চোখের সমস্যা সৃষ্টি হওয়ায় পড়াশোনা প্রায় ছেড়ে দেন। অন্য ভাইয়েরা কৃতী হয়ে উঠলেও তিনি যে পারছিলেন না। ধীরে ধীরে বাড়িতে বাড়তে থাকে তাঁর প্রতি গঞ্জনা। তিনি সন্ধান করতে থাকেন কর্মসংস্থানের ঠিকানা।

কর্মজীবন

কর্মের সন্ধানে আশুতোষ বাবু একের পর এক মোট নয়টি জায়গায় চাকরি নেন এবং ছেড়েও দেন। ব্যক্তিগত উদ্যোগে এবং নিজ ব্যয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজেও উদ্যোগী হন। সেখানেও বিশেষ সফলতা আসে না। এরপর তিনি শুরু করেন গেঞ্জির ব্যবসা। গড়ে তোলেন প্রকাশন সংস্থা ‘ম্যানুস্ক্রিপ্ট’। শেষাবধি চাকরি নেন ‘যুগান্তর’ পত্রিকায়। সময়কাল ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দ। এই পত্রিকার রবিবাসরীয় বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন অনেকদিন। এর মাঝে ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে মমতা দেবীর সঙ্গে পরিণয় বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দের ৪ মে কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়।

সাহিত্যজীবন

তিনি যখন সাহিত্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন সে সময় বাংলাদেশে নানা ক্ষেত্রে অবক্ষয়ের পালা চলছিল। পাশাপাশি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রভাব। ভাঙন, মূল্যবোধের অবক্ষয়, অর্থনীতি কি রাজনীতি সর্বত্রই এক জিজ্ঞাসার মুখে গোটা সমাজটা। এই রকমই এক পটভূমিতে আবির্ভাব সাহিত্যিক আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের।

লেখকের প্রথম গল্প ‘নার্স মিত্র’ প্রকাশ পায় ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে ‘বসুমতী’ পত্রিকায়। অনেকে হয়তো জানেন যে, বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘দ্বীপ জ্বেলে যাই’ এই গল্প অবলম্বনেই সৃষ্ট। তাঁর গল্প ও উপন্যাস নিয়ে প্রায় দুশো রচনা আছে। এর মধ্যে অনেক রচনাই চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। অনেক রচনা ভারতের বিভিন্ন ভাষায় হয়েছে অনূদিত।

রচনা পরিচিতি

চলাচল (১৯৫১) উপন্যাসেই তাঁর প্রথম প্রতিষ্ঠা। স্বাধীন দেশের একটি কর্মকান্ড নিয়ে লেখা এই উপন্যাস।

পঞ্চতপা (১৯৫৮) উপন্যাসটি স্বাধীন ভারতের একটি কর্মকান্ড মড়াই নদীর বাঁধ নির্মাণকে পটভূমি করে রচিত এই উপন্যাস। প্রকৃতি ও মানবের লড়াই এবং শেষাবধি প্রকৃতির কাছে মানুষের আত্মসমর্পণই মুখ্য বক্তব্য এই উপন্যাসের। বর্তমান মানুষের ধনলিপ্সা, অর্থলোভ তাকে কোন অজানা দেশে নিয়ে যাচ্ছে তারই কাহিনী সোনার হরিণ নেই (১৯৭৯) উপন্যাসটি। লৌকিক ও অলৌকিকের মিশ্রণ আছে তাঁর শতরূপে দেখা (১৯৭১) উপন্যাসে।

নগরপারে রূপনগর (১৯৬৭) উপন্যাসে তুলে ধরা হয়েছে দৈনন্দিন জীবনের জটিলতা, লোভ, হিংসা, বিদ্বেষমাখা নগর পেরিয়ে এক অন্য নগরের সন্ধানই যেন এই উপন্যাসের মূল বক্তব্য। উপন্যাসে তিনটি পুরুষের কাহিনী বলা হয়েছে। কাল তুমি আলেয়া (১৯৬২) মানুষের জীবনের অন্তহীন জটিলতা এবং তা থেকে মুক্তির পথ সন্ধানই এই উপন্যাসের মুখ্য বক্তব্য বিষয়। উপন্যাসটির কাহিনী অবলম্বনে শচীন মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র) সাত পাকে বাঁধা উপন্যাসে বিবাহ বিচ্ছেদ সংক্রান্ত হিন্দু কোড ও প্রেমের দ্বন্দ্ব আছে। পরকপালে রাজারানী (১৯৮৯) লেখকের জীবনকালে প্রকাশিত শেষ উপন্যাস। উপন্যাসে আছে লৌকিক ও অলৌকিকের মিশ্রণ।

তাঁর অন্যান্য উপন্যাসগুলির মধ্যে আছে জীবনতৃষ্ণা (১৯৫১), অলকাতিলক (১৯৬০), অগ্নিমিতা (১৯৬১), রোশনাই (১৯৬২), নতুন তুলির টান (১৯৬৮) বিদেশিনী (১৯৬৯), সারি তুমি কার (১৯৭২), রূপের হাটে বিকিকিনি (১৯৭৪), নিষিদ্ধ বই (১৯৮১)

পুরষ্কার

সাহিত্য জগতে অবদানের জন্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায় পেয়েছেন মতিলাল সাহিত্য পুরষ্কার – ‘সেই অজানার খোঁজে’ উপন্যাসের জন্য। এছাড়া বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ পুরষ্কার এবং মৃত্যুর পর সুবোধ ঘোষ স্মৃতি পুরষ্কার দেওয়া হয় তাঁকে। সিনেমা জগতে অবদানের জন্য বাংলা চলচ্চিত্র প্রসার সমিতি থেকে শ্রেষ্ঠ কাহিনীকারের পুরষ্কার পেয়েছেন তিনি।

আলোচক – নীলরতন চট্টোপাধ্যায়, শিক্ষক, সম্পাদক – এসএসসি টার্গেট, এসএলএসটি বাংলা প্রগ্রেসিভ পাব্লিশার্স (কলকাতা)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *