
রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ সাহিত্য
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কেবল একজন বিশ্বখ্যাত কবিই নন, বাংলা সাহিত্য জগতের সর্বক্ষেত্রে তাঁর সুনিপুণ বিচরণ। কী নাট্যসাহিত্য, কী কথাসাহিত্য, কী প্রবন্ধ সাহিত্য যেখানেই তাঁর স্পর্শ পড়েছে তা সার্থকসুন্দর হয়ে উঠেছে। আমাদের রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ সাহিত্য আলোচনায় আমরা কবিগুরুর বিভিন্ন ধরনের প্রবন্ধ সাহিত্য বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে যা PSC, SLST কিংবা অন্যান্য পরীক্ষার জন্য সহায়ক হতে পারে।
সাহিত্যতত্ত্ব বিষয়ক প্রবন্ধ
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধগ্রন্থগুলি হল ‘সাহিত্য’ (১৯০৭), ‘সাহিত্যের পথে’ (১৯৩৬) এবং ‘সাহিত্যের স্বরূপ’ (১৯৪৩)। এই সমস্ত গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের নানাবিধ তত্ত্ব ও সাহিত্যের নানা রূপ ব্যাখ্যা করেছেন। গ্রন্থগুলির বিভিন্ন প্রবন্ধে ধরা পড়েছে সাহিত্যের তাৎপর্য, তার ধর্ম, বাস্তবতা ও আধুনিকতা। সাহিত্য তথা শিল্পসৃষ্টিতে ব্যক্তিজগতের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে ‘সাহিত্যের তাৎপর্য’ প্রবন্ধে। তবে সাহিত্য তত্ত্ব নিয়ে রবীন্দ্রনাথের প্রথম দুটি প্রবন্ধ প্রকাশ পেয়েছিল ‘ভারতী’ পত্রিকায়। প্রকাশকাল যথাক্রমে ১২৯৩ চৈত্র ও ১২৯৪ বৈশাখ। প্রবন্ধদুটি হল – কাব্যঃ স্পষ্ট ও অস্পষ্ট এবং সাহিত্যের উদ্দেশ্য।
ধর্ম ও দর্শন বিষয়ক প্রবন্ধ
রবীন্দ্রনাথের ধর্ম ও দর্শন বিষয়ক প্রবন্ধগ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘ধর্ম’ (১৯০৯), ‘শান্তিনিকেতন’ (১৯০৯), ‘সঞ্চয়’ (১৯১৬), ‘মানুষের ধর্ম’ (১৯৩৩) ইত্যাদি। এই ধরনের প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের ধর্মবোধ ও ঈশ্বর-চেতনার বিবিধ সমাবেশ ঘটেছে। শুধু তাই নয়, এই প্রবন্ধগুলিতে লেখকের ধর্ম ও দর্শন ভাবনার একত্র সমাবেশ ঘটেছে। ‘শান্তিনিকেতন’ গ্রন্থে লেখকের সত্যানুভূতি, বিশ্বমানবতার প্রকাশ। রবীন্দ্রনাথ শাশ্বত মানবধর্মের প্রতি আস্থাশীল ছিলেন। ধর্মের মহত্ব জাতি ও বর্ণ নির্বিশেষে সাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠা। ধর্ম বিচ্ছেদ নয়, ঐক্যের ও মিলনের কথা বলে। লেখকের এই শ্রেণির প্রবন্ধগুলিতে তারই স্বরূপ প্রকটিত হয়েছে।
স্বদেশ ও রাষ্ট্র-ভাবনা বিষয়ক প্রবন্ধ
রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ ও রাষ্ট্র-রাজনীতি বিষয়ক প্রবন্ধগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘আত্মশক্তি’ (১৯০৫), ‘রাজা প্রজা’ (১৯০৮), ‘স্বদেশ’ (১৯০৮), ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম’ (১৯১৭), ‘কালান্তর’ (১৯৩৭), ‘সভ্যতার সঙ্কট’ (১৯৪১) প্রভৃতি। তবে ১২৯৭ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যায় ‘ভারতী’তে প্রকাশিত ‘মন্ত্রি অভিষেক’ লেখকের প্রথম সার্থক রাজনৈতিক প্রবন্ধ। এই ধরনের প্রবন্ধে লেখকের রাজনীতি ও স্বদেশ ভাবনার বিশেষ প্রকাশ ঘটেছে। ‘আত্মশক্তি’ গ্রন্থের মূল সুর স্বকীয় শক্তিতে দৃঢ়বিশ্বাস। ‘রাজা প্রজা’য় লেখক নানা প্রকার সমস্যা সমাধানের পথ-নির্দেশে প্রয়াসী হয়েছেন। ‘কালান্তরে’ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত লেখকের রাজনৈতিক চিন্তাধারার পরিচয় মেলে। গ্রন্থের ‘লোকহিত’ প্রবন্ধে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্ত্যের রাজনীতি, সমাজনীতি এবং শিক্ষানীতির পারস্পরিক তুলনা করা হয়েছে।
শিক্ষা বিষয়ক প্রবন্ধ
রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা বিষয়ক প্রবন্ধগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘শিক্ষা’ (১৯০৮), ‘শিক্ষার মিলন’ (১৯২১), ‘শিক্ষার বিকিরণ’ (১৯৩৩), ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ’ (১৯৩৩), ‘আশ্রমের রূপ ও বিকাশ’ (১৯৪১) প্রভৃতি। এই সমস্ত গ্রন্থে তিনি দেশের শিক্ষাদান পদ্ধতি, তার নানা সমস্যা এবং শিক্ষা পরিকল্পনা বিষয়ে সুচিন্তিত মতামত প্রদান করেছেন। রবীন্দ্রনাথ কেবল কবিই নন, একজন যথার্থ শিক্ষাগুরুও বটেন। কবির মধ্যে শিক্ষা সম্পর্কে যে মৌলিক ভাবনা ছিল তা প্রকাশ পেয়েছে উক্ত প্রবন্ধগ্রন্থগুলিতে। দেশের প্রচলিত নীরস শিক্ষাপদ্ধতি শিক্ষার্থীর সর্বাঙ্গীন বিকাশে সক্ষম নয় তা তিনি উপলব্ধি করেছেন। যুক্তি সহকারে তিনি বুঝিয়েছেন, দেশে শিক্ষাবিস্তারে ইংরেজি নয়, মাতৃভাষাই শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। ভারতের প্রাচীন তপোবনীয় ঐতিহ্যে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে শিক্ষাদানের গুরুত্বের কথা তিনি বারেবারেই বলেছেন। কবির সেই চিন্তাধারার ফলশ্রুতি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়।