বাংলা সাহিত্যবৈষ্ণব পদাবলিশ্রীকৃষ্ণকীর্তন

বাংলা সাহিত্যে চণ্ডীদাস সমস্যা

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে চণ্ডীদাস উল্লেখযোগ্য এক নাম। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে ঠিক কতজন চণ্ডীদাস ছিলেন এবং তারা কোন্‌ কোন্‌ ধারার কবি ছিলেন তা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। ফলে সৃষ্টি হয়েছে চণ্ডীদাস সমস্যা । আমাদের এই আলোচনায় সে বিষয়েই আলোকপাত করা হয়েছে।

চণ্ডীদাস সমস্যা -এর সূত্রপাত

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন আবিষ্কারের আগে চণ্ডীদাসকে নিয়ে তেমন সমস্যা হয়নি। কিন্তু পরবর্তীকালে এই সমস্যা চরমে পৌঁছলেও আজ পর্যন্ত সঠিক প্রমাণের অভাবে যথোপযুক্ত সমাধানে আসা যায়নি। মোটামুটিভাবে এ পর্যন্ত চারজন চণ্ডীদাসের নাম পাওয়া যায় – বড়ু চণ্ডীদাস, পদাবলীর চণ্ডীদাস, দীন চণ্ডীদাস এবং দ্বিজ চণ্ডীদাস। প্রথম দুই চণ্ডীদাস চৈতন্য-পূর্ববর্তী আর শেষ দুই চণ্ডীদাস চৈতনোত্তর বলে মনে করা হয়। বড়ু চণ্ডীদাস এবং তাঁর শ্রীকৃষ্ণকীর্তন যে চৈতন্য পূর্ববর্তী তার সমর্থনে অধ্যাপক মণীন্দ্রমোহন বসু দেখিয়েছেন –

ক. শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে রাধা লক্ষ্মীর অবতার কিন্তু চৈতন্য পরবর্তী বৈষ্ণব পদে রাধা সখীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠা, কৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তিরূপা।

খ. শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে রাধা এবং চন্দ্রাবলী একই কিন্তু চৈতন্যোত্তর বৈষ্ণব কবিতায় তারা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বিনী।

গ. শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে বড়াই রাধাকৃষ্ণের একমাত্র প্রণয় সাধিকা কিন্তু চৈতন্য পরবর্তী বৈষ্ণব পদে বড়াই স্থানচ্যূত হয়েছে।

অপর এক চণ্ডীদাসও যে চৈতন্য-পূর্ব তার স্বপক্ষে ড. বিমানবিহারী মজুমদার সহ অনেকেই যুক্তি দিয়েছেন।

‘হায় হায় প্রাণ সখি কিনা হৈল মোরে।
কানু প্রেম বিষানলে তনু মন জারে।।’

অতঃপর ?

‘চৈতন্যচরিতামৃতে’ (মধ্য/তৃতীয়) কৃষ্ণদাস কবিরাজ জানিয়েছেন, সন্ন্যাস গ্রহণের পর অদ্বৈতগৃহে আনীত মহাপ্রভু এই সুললিত পদটি মুকুন্দের কন্ঠে শুনে ‘নির্বেদ বিষাদমর্ষ চাপল্য গর্বদৈন্য’তে আবিষ্ট হয়েছিলেন। ১৩৩১ বঙ্গাব্দে পণ্ডিত হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় এই সম্পূর্ণ পদটি চণ্ডীদাসের ভণিতায় আবিষ্কার করে প্রকাশ করেন। কিন্তু সমালোচকেরা পদটি বড়ু চণ্ডীদাসের বলে নির্দেশ করেছিলেন। অন্যদিকে ড. মজুমদার বলেন, বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে রাধা সর্বত্র বড়াইকে দুঃখের কথা শুনিয়েছেন, সখীকে নয়। অতএব চৈতন্যদেব যে চণ্ডীদাসের পদ আস্বাদন করতেন ইনিই সেই চণ্ডীদাস। ‘চৈতন্যচরিতামৃতে’ আছে –

‘বিদ্যাপতি চণ্ডীদাস শ্রীগীতগোবিন্দ।
এই তিন গীতে করায় প্রভুর আনন্দ।।’

কিংবা

চণ্ডীদাস বিদ্যাপতি            রায়ের নাটকগীতি
কর্ণামৃত শ্রীগীতগোবিন্দ।
স্বরূপ রামানন্দ সনে           মহাপ্রভু রাত্রদিনে
গায় শুনে পরম আনন্দ।।

চৈতনোত্তর দু’জন চণ্ডীদাসের মধ্যে দীন চণ্ডীদাস অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও নীরস পদ রচনা করেছেন। দ্বিজ চণ্ডীদাসের অস্তিত্ব প্রধানত অনুমানের উপর নির্ভরশীল। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ লিখেছেন – ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের বাহিরে বড়ু চণ্ডীদাসের পদ নাই।’ (বড়ু চণ্ডীদাসের পদ, সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা)

আলোচক – নীলরতন চট্টোপাধ্যায়

তারিখ – ১৫.০১.২০২৫

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Get Latest Updates For Free! Put Your Email Below.


This will close in 20 seconds